মাওলানা মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৩, ০৯:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলামে কথাবার্তা বলার শিষ্টাচার

ইসলামে কথাবার্তা বলার শিষ্টাচার
মানুষের মুখের কথা এক প্রকার সম্মোহনী শক্তি। এর মাধ্যমে মানুষ অন্যদের কাছে টানে বা দূরে ঠেলে দেয়। কথার মাধ্যমে মানুষ নিজের আসন ও অবস্থান তৈরি করে। মানুষের পরিচয় মেলে মুখের কথায়। কারও কথায় মধু থাকে, কারও কথায় বিষও থাকে। কথার মাধ্যমে মানুষ পৌঁছে যেতে পারে জান্নাতে। আবার কথা জাহান্নামে যাওয়ার কারণও হতে পারে। কথাবার্তার বিষয় ও প্রকাশ দুটোই বিচিত্র। এ জন্য ইসলামের নির্দেশনা হচ্ছে, মুসলমান ভালো কথা বলবে, অন্যথায় চুপ থাকবে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে, সে যেন উত্তম কথা বলে অথবা চুপ থাকে।’ (বুখারি : ৬৪৭৫)। উত্তম কথা বলা যেমন পুণ্যের কাজ, তেমনি মন্দ কথা বলা বড় গুনাহের কাজ। কথা বলা অনেক সময় বিপজ্জনক, আত্মঘাতী ও সর্বনাশী হয়। জাহান্নামের শাস্তিও বয়ে আনতে পারে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকো, এক টুকরো খেজুরের বিনিময়ে হলেও। যদি সেটা কেউ না পায় তাহলে সে যেন উত্তম কথা বলে।’ (বুখারি : ৬০২৩) মানুষের প্রতিটি কথা রেকর্ড করা হয়। এ জন্য আল্লাহতায়ালা প্রতিটি মানুষের সঙ্গে দুজন দায়িত্বশীল ফেরেশতা নিযুক্ত করে দিয়েছেন। তারা আমাদের আমলনামা লেখেন। ডান কাঁধের ফেরেশতা নেক আমলসমূহ লেখেন এবং বাম কাঁধের ফেরেশতা গুনাহসমূহ লিপিবদ্ধ করেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা-ই গ্রহণ করার জন্য তার কাছে সদা প্রস্তুত প্রহরী রয়েছে।’ (সুরা কাফ : ১৮)। পরকালে মুখ নিঃসৃত প্রতিটি কথার জবাবদিহি করতে হবে। তাই মুখে সংযম রাখা মুসলমানের কর্তব্য। অতিরিক্ত কথা বলা বা বাচাল স্বভাব ধারণ করা অনুচিত। মানুষও এসব ভালো চোখে দেখে না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যার চরিত্র ও আচরণ সর্বোত্তম, সে-ই আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় এবং কিয়ামত দিবসেও সে আমার খুবই নিকটে থাকবে। আর তোমাদের যে ব্যক্তি আমার নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণ্য, সে ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে আমার থেকে অনেক দূরে থাকবে; তারা হলো বাচাল, ধৃষ্ট-নির্লজ্জ এবং অহংকারে মত্ত ব্যক্তি।’ (তিরমিজি : ২০১৮) রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সেসব লোককে ঘৃণা করেন, যারা বাকপটুত্ব প্রদর্শনের জন্য জিহ্বাকে দাঁতের সঙ্গে লাগিয়ে বিকট শব্দ করে, গরু তার জিহ্বা নেড়ে যেমন করে থাকে।’ (আবু দাউদ : ৫০০৫)। ভান করে বা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়ে কথা বলাও ঠিক নয়। সহজ-সরলভাবে কথা বলা মুমিনের জন্য জরুরি। সেই সঙ্গে অহেতুক তর্ক-বিতর্ক এড়িয়ে চলা উচিত। একই সঙ্গে দুজন কথা বলা অনুচিত। একজনের কথা বলার মাঝখানে অন্যজন কথা বলা ঠিক নয়। এমন করলে কেউ কারও কথা শুনবে না বা বুঝবে না। তা ছাড়া এর দ্বারা কথার ছন্দপতন ঘটে, গতিশীলতা হ্রাস পায়। তাই নিয়ম হলো, একজনের কথা শেষ হলে আরেকজন কথা বলবে। অনুরূপভাবে এক বিষয়ে কথা বলার মাঝখানে অন্য বিষয় উত্থাপন করাও শিষ্টাচার পরিপন্থি। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘একদিন আল্লাহর রাসুল (সা.) একটি মজলিসে জনসম্মুখে কথা বলছিলেন। ইতোমধ্যে তার কাছে জনৈক বেদুইন এসে জিজ্ঞেস করল, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? রাসুল (প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে) আলোচনায় রত থাকলেন। এতে কেউ কেউ বললেন, লোকটি যা বলেছে রাসুল (সা.) তা শুনেছেন; কিন্তু তার কথা পছন্দ করেননি। আর কেউ কেউ বললেন, বরং তিনি শুনতেই পাননি। রাসুল (সা.) আলোচনা শেষ করে বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? সে বলল, এই যে আমি, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি বললেন, যখন কোনো অনুপযুক্ত ব্যক্তির ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (বুখারি : ৫৯) সমাজে শোনা কথা যাচাই না করে প্রচার করে দেওয়ার প্রবণতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মাধ্যমে সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা হচ্ছে, ‘কোনো পাপী ব্যক্তিও যদি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ নিয়ে আসে তবে ভালোভাবে যাচাই করে দেখবে, যাতে তোমরা অজ্ঞতাবশত কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতি না করে বসো। ফলে নিজেদের কৃতকর্মের কারণে তোমাদের অনুতপ্ত হতে হয়।’ (সুরা হুজুরাত : ৬)। রাসুল (সা.) বলেন, ‘মানুষ মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।’ (মুসলিম : ৫)। শোনা কথা বলে বেড়ানো মানুষকে বিভ্রান্ত করারই নামান্তর। কাজেই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা কাম্য। কোথাও তিনজন একত্রে থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে অন্য দুজন কানাকানি কথা বলা অনুচিত। দুজন এমন ইঙ্গিতে কথা বলাও উচিত নয়, যা তৃতীয়জনের বোধগম্য নয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা তিনজন থাকলে একজনকে বাদ দিয়ে দুজন কানে-কানে কথা বলবে না। এতে সে মনে কষ্ট পাবে। তোমরা পরস্পর মিলে গেলে তবে তা করাতে দোষ নেই।’ (বুখারি : ৬২৯০)। অবশ্য চারজন বা এর অধিক হলে দুজনে কানাকানি করা নিষিদ্ধ নয়। পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ উচ্চারণে স্পষ্ট করে কথা বলা চাই। বাক্যের প্রতিটি শব্দ যেন শ্রোতা সহজেই বুঝতে সক্ষম হয়। পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বললে শ্রোতার মনে প্রভাব পড়ে বেশি। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহর (সা.) কথা এত সুস্পষ্ট ছিল যে, প্রত্যেক শ্রোতা তার কথা বুঝত।’ (আবু দাউদ : ৪৮৩৯)। পাশাপাশি ধীরস্থিরতার সঙ্গে কথা বলাও সুন্নত। খুব দ্রুতগতিতে কথা বলা, যা মানুষের বুঝতে কষ্ট হয় তা দোষণীয়। রাসুল (সা.) কথাবার্তায় ধীরস্থির ছিলেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) এমনভাবে কথা বলতেন, যদি কোনো গণনাকারীর গণনা করতে ইচ্ছা করে তবে সে গুনতে পারবে।’ (মুসলিম : ৭৩৯৯)। কথা যেন বিশুদ্ধ হয়। রাসুল (সা.) নিজেই বলেছেন, ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী।’ (তাবাকাতুশ-শাফিইয়াতিল কুবরা : ৬/৩২৪) কথা বলার অন্যতম আদব হলো, সালাম দিয়ে কথা শুরু করা। এর মাধ্যমে পরস্পরের জন্য শান্তি, কল্যাণ ও নিরাপত্তা কামনা করা হয়। ফলে উভয়ের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভালোবাসা ও হৃদ্যতা। কথা বলার আগে সালাম দেওয়া রাসুল (সা.)-এর সুন্নত। জাবের (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কথা বলার আগেই সালাম বিনিময় হবে।’ (তিরমিজি : ৬২৯৯)। কথা বলার শেষেও সালাম দেওয়া সুন্নত। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ কোনো মজলিসে উপস্থিত হলে সে যেন সালাম করে, তারপর তার ইচ্ছা হলে বসে পড়বে, তারপর সে যখন উঠে দাঁড়াবে তখনো যেন সালাম করে। কেননা পরের সালামের চেয়ে প্রথম সালাম বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।’ (তিরমিজি : ২৭০৬) কিছু মানুষকে দেখা যায়, শুধু নিজেই কথা বলতে পছন্দ করে। অন্যকে কথা বলার সুযোগ কম দেয়। এটা খুবই অশোভনীয় বিষয়। এটা পরিবর্তন করা আবশ্যক। বরং অন্যের কথা শুনতে হবে ও তাদের বলার সুযোগ দিতে হবে। আর কোনো মজলিসে কথা বলার ক্ষেত্রে বয়োজ্যেষ্ঠকে প্রাধান্য দিতে হবে। হজরত সাহল ইবনে আবু হাসমাহ (রা.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে সাহল ও মুহাইয়িসা ইবনে মাসউদ বিন যায়েদ (রা.) খায়বারের দিকে গেলেন। তখন খায়বারের ইহুদিদের সঙ্গে সন্ধি ছিল। পরে তারা উভয়ে আলাদা হয়ে গেলেন। তারপর মুহাইয়িসা আবদুল্লাহ বিন সাহলের কাছে এসে বলেন, তিনি মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছেন। তখন মুহাইয়িসা তাকে দাফন করলেন। অতঃপর তারা দুজন মদিনায় এলেন। আবদুর রহমান ইবনে সাহল ও মাসউদের দুই পুত্র মুহাইয়িসা ও হুওয়াইয়িসা নবীজির কাছে গেলেন। আবদুর রহমান (রা.) কথা বলার জন্য এগিয়ে এলে রাসুল (সা.) বললেন, ‘বড়কে আগে বলতে দাও, বড়কে আগে বলতে দাও’। আর আবদুর রহমান ইবনে সাহল (রা.) ছিলেন বয়সে সবচেয়ে ছোট। তখন তিনি চুপ রইলেন এবং মুহাইয়িসা ও হুওয়াইয়িসা উভয়ে কথা বললেন। (বুখারি : ৩১৭৩)। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘ওমর (রা.) যখন প্রবীণ সাহাবিদের ডাকতেন, তখন সেই সঙ্গে আমাকেও ডাকতেন। আর বলতেন, তারা যতক্ষণ কথা না বলেন, ততক্ষণ তুমি কথা বলো না। (মুসনাদে আহমাদ : ৮৫) কথাবার্তা আমাদের যাপিত জীবনের অনিবার্য অনুষঙ্গ। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সবাইকেই কমবেশি কথা বলতে হয়। বিষয়টি যেমন বিস্তৃত, তেমনি এর বিধান ও আদবও বিস্তৃত। আমাদের কর্তব্য, কথাবার্তায় সাবধানতা অবলম্বন করা এবং নিত্য এর পরিশীলনে যত্নবান হওয়া। অন্যথায় সামান্য জিহ্বা নিয়ে আসতে পারে বড় বিপর্যয়। হাদিসে এসেছে, ‘মানুষ সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় তার সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিনীতভাবে জিহ্বাকে বলে—তুমি আমাদের ব্যাপারে আল্লাহতায়ালাকে ভয় করো। আমরা তো তোমার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তুমি যদি সোজা পথে দৃঢ় থাকো তাহলে আমরাও দৃঢ় থাকতে পারি। আর তুমি যদি বাঁকা পথে যাও তাহলে আমরাও বাঁকা পথে যেতে বাধ্য।’ (তিরমিজি : ২৪০৭)। মনে রাখতে হবে, কথা এক প্রকার একটি তীর। ধনুক থেকে তীর বের হলে যেমন তা আর ফিরিয়ে আনা যায় না, কথাও ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। সুতরাং কথাবার্তায় সংযমী হওয়া এবং ভেবেচিন্তে কথা বলা কাম্য ও নিরাপদ। লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরানের ইসফাহান পারমাণবিক স্থাপনায় বিস্ফোরণ

খুঁজে খুঁজে ইসরায়েলের অর্ধশতাধিক গুপ্তচরকে ধরল ইরান

রাষ্ট্রবিরোধী প্রচারণার অভিযোগে বাসদের নেতা আটক

সরকারের সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়: সিইসি

নিজের ‘আমলনামা চুরি’ করলেন সাবেক অধ্যক্ষ

‘প্রেমিক হয়ে জন্মেছিলেন, কিন্তু হয়েছেন সর্বোচ্চ নেতা’

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়াসহ ৪ দেশ

ওএসডি হচ্ছেন শরীয়তপুরের বিতর্কিত ডিসি আশরাফ

শান্তির ডাকে যুদ্ধ আরও জটিল রূপ নিচ্ছে না তো?

ট্রাম্পের হম্বিতম্বির নেপথ্যে কী

১০

নতুন দায়িত্ব নেওয়া ইরানি ড্রোন কমান্ডারকেও মেরে ফেলল ইসরায়েল

১১

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মতুয়া সম্প্রদায়ের পাশে পূজা উদযাপন পরিষদ

১২

ময়মনসিংহে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১১

১৩

থানায় রক্ষিত বাক্স ভেঙে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র

১৪

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত / ৫৭ দেশের সহস্রাধিক মুসলিম নেতা বৈঠকে বসছেন আজ

১৫

নতুনবাজার অবরোধ করলেন ইউআইইউর শিক্ষার্থীরা

১৬

ছাত্রাবাস থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার

১৭

ইরানের ভূকম্পন কি গোপন পারমাণবিক পরীক্ষা?

১৮

দিনে কতবার প্রস্রাব হওয়া স্বাভাবিক? কিডনি সমস্যার লক্ষণ নয়তো

১৯

ইরানের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পরস্পরবিরোধী বার্তা

২০
X