গরমের দিনে ঘাম হওয়া অতি সাধারণ একটি বিষয়। গরমে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে তা স্বাভাবিক রাখতে ঘাম হয়। এ ছাড়া ঘামের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ বেরিয়ে যায়। তবে মাত্রাতিরিক্তি ঘাম নানা রোগের লক্ষণ হতে পারে। বিস্তারিত জানাচ্ছেন
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সাধারণত ব্যায়াম, গরম আবহাওয়া, ভয় বা রাগের মতো নেতিবাচক আবেগের কারণে ঘাম হতে পারে। এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। তবে ঘাম দুই প্রকার—এক্রিন ঘাম এবং এপোক্রিন ঘাম। কায়িক পরিশ্রম করলে বা বাইরের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এক্রিন গ্রন্থি থেকে ঘাম নিঃসরণ শুরু হয়। ডাক্তারি ভাষায় এই ঘামকে এক্রিন ঘাম বলে। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের শরীরে ২০ থেকে ৪০ লাখ এক্রিন গ্রন্থি থাকে। এই ঘাম স্বাভাবিক।
অন্যদিকে এপোক্রিন গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত ঘামকে এপোক্রিন ঘাম বলে। এপোক্রিন গ্রন্থি বয়ঃসন্ধিকালের শুরু থেকে সক্রিয় হতে শুরু করে। সাধারণ বগল এবং যৌনাঙ্গের চারপাশে এপোক্রিন গ্রন্থি থাকে। সাধারণ শরীরে দুর্গন্ধ সৃষ্টির পেছনে এই এপোক্রিন গ্রন্থি দায়ী। এই গ্রন্থির ঘাম লোমকূপ থেকে বের হয়ে জীবাণুর সঙ্গে বিক্রিয়া করে গন্ধের সৃষ্টি করে। সাধারণত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, স্থূলতা, শরীরে পুষ্টির অভাবসহ নানা কারণে এপোক্রিন গ্রন্থির ঘাম নিঃসরণ বেড়ে যেতে পারে। এ ছাড়া ডায়াবেটিস, জ্বর, হৃদযন্ত্রের সমস্যা, মেনোপজ ও লিউকোমিয়া ইত্যাদি কারণেও শরীর বেশি ঘাম হতে পারে। অতিরিক্ত ঘাম শরীরের বিভিন্ন জায়গা যেমন হাতের তালু, পায়ের নিচে, বগল, গলা, কপাল, এমনকি মাথার ত্বকেও ক্ষতিকর। শরীরের ঘাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলে তাকে হাইপারহাইড্রোসিস রোগ বলা হয়।
কারণ ও প্রকারভেদ
সাধারণত শুরুতে হাইপারহাইড্রোসিস রোগে হাত, পা, বগল, কুঁচকি এবং মুখে অতিরিক্ত ঘামের লক্ষণ দেখা দেয়। একে প্রাইমারি বা ফোকাল হাইপারহাইড্রোসিস বলে। নানা কারণে প্রাইমারি বা ফোকাল হাইপারহাইড্রোসিস হতে পারে। তবে এর সঠিক কারণ এখনো জানা যায়নি। গবেষকরা ধারণ করেন, সহানুভূতিশীল স্নায়ুতন্ত্রের অতিরিক্ত উদ্দীপনার কারণে এটি হতে পারে। কিছু কিছু রোগী ঘামের কারণে নার্ভাস হয়ে যায় এবং এই নার্ভাসনেসই তাদের ঘামের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস এই রোগের আরেকটি পর্যায়। নির্দিষ্ট কোনো রোগের কারণে শরীরে অতিরিক্ত ঘাম হওয়াকে বলে সেকেন্ডারি হাইপারহাইড্রোসিস। যেমন—বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, লিম্পোমা, ফ্রিওত্রোমোসাইটোমা, কারসিনয়েড টিউমার ইত্যাদি। ডায়বেটিস, বিশেষ করে যখন রোগীর ব্লাড সুগার কমে যায়, হাইপারপিটুইটারিজম, হাইপারথাইরয়ডিজম। দীর্ঘদিন বিভিন্ন ওষুধের যেমন—সেরোটনিন ইনহিবিটারস, অ্যান্টি ডিপ্রেসিভ ড্রাগস, ইনসুলিন, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস ইত্যাদির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অত্যাধিক ঘামের কারণ হতে পারে। উপরের কারণগুলো ছাড়াও স্পাইনালকর্ড ইনজুরি, পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি, পারকিনসনস, কনজেসটিভ হার্ট ফেলিওর, মেনোপজ, ওবেসিটি ইত্যাদি কারণে থাকতে পারে।
অতিরিক্ত ঘামের ঝুঁকি
অতিরিক্ত ঘাম নিঃসরণে ফলে শরীরের স্বাভাবিক নিয়মে বেশি কিছু পরিবর্তন হয়। হাইপারহাইড্রোসিসের কারণে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে থাকে এবং অতিরিক্ত ঘামে শরীরে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দিতে পারে। দীর্ঘসময় ত্বক ক্রমাগত ভেজা থাকার কারণে ত্বকে নানা ধরনের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত ঘামের ফলে শরীরে এবং পায়ে দুর্গন্ধ হয় বলে রোগী হীনমন্যতায় ভোগেন। শিশুদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘাম বসে গিয়ে ঘন ঘন সর্দি-কাশি ও জ্বর হতে পারে।
করণীয়
চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগের কার্যকর কোনো ওষুধ নেই। তবে দৈনন্দিন জীবনযাপনে কিছু বিষয় মেনে বেশি ঘামের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
শারীরিক দুর্বলতা বেশি ঘামের কারণ হতে পারে। তাই পুষ্টিকর খাবার, শাকসবজি, বেশি করে পাকা ফলমূল খান। ফলমূল ও শাকসবজি খেতে হবে।
অতিরিক্ত ঘাম নিয়ন্ত্রণে যেসব খাদ্যে বেশি পরিমাণে ভিটামিন বি-১২ পাওয়া যায় সেসব খাদ্য গ্রহণ করুন। যেমন—কলা, ডিম, দুধ, গাজর, টমেটো, সবুজ শাক, মাছ, কাঠ বাদাম ইত্যাদি।
ভিটামিন বি পরিবার যেমন—বি-১, বি-২, বি-৩, বি-৫ যুক্ত খাদ্য প্রতিদিন খাওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ভিটামিন বি ট্যাবলেট গ্রহণ করা যেতে পারে।
আয়োডিনযুক্ত খাবার যেমন—এসপারাগাস, ব্রকোলি, টারকি, গরুর মাংস, যকৃৎ, সাদা পেঁয়াজ, খাবার লবণ প্রভৃতি থেকে এটি হয়ে থাকে। তাই এগুলো খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
নিয়মিত ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ঘাম ঝরানো ব্যায়াম করুন। তারপর গোসল করলে সারা দিন শরীর সতেজ থাকবে। ধূমপান, অতিরিক্ত চা-কফি, মদপানসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় অভ্যাস ত্যাগ করুন।
লেখক : প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি