এখন ফোন করে বা এসএমএস পাঠিয়ে বড়জোর বলা হয় ‘দুপুরে খেয়েছো?’। কিন্তু মায়ের কাছে বলার জন্য আরও কত যে গল্প আকুলিবিকুলি করে। ক্যাম্পাসের চৌহদ্দিতে আটকে পড়া মন সেই গল্প বলার সুযোগই পায় না। মায়ের কাছে মনের কথা পাঠাতে কালবেলার ক্যাম্পাসে তাই ছাপা হলো কিছু খোলা চিঠি। যে কথাগুলো আসলে সব সন্তানেরই। চিঠিগুলো সংগ্রহ করেছেন সিফাত রাব্বানী ও আজহার মাহমুদ।
কদিন তোমার মালা কিনব
ফারহানা ইয়াসমিন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
আজ থেকে বাইশ/তেইশ বছর আগের কথা। সোনার ভরি তখন সাড়ে ৬ হাজারের মতো। ওই সময় একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে এটা অনেক। তখন বাবার সীমিত আয়ের তুলনায় মা তোমার কাছে সোনার গহনা কেনা ছিল বিলাসিতা। তবে ছোট বেলায় গল্পের ছলে তোমার মুখে শুনতাম স্বর্ণের মালা তোমার খুব পছন্দের। এরপর প্রায় ১২ বছর মেয়াদে প্রতি মাসে একশ টাকার একটি বীমা শুরু করলে। তুমি চেয়েছিল বীমার টাকা দিয়ে শখ পূরণ করবে। কিন্তু সেই টাকা তুলে আমায় কিনে দিলে ল্যাপটপ। বাড়ি ফিরে তোমার চোখে মুখে দেখেছিলাম স্বস্তির ছাপ। ল্যাপটপ কেনা হলো। কেনা হলো না তোমার গলার মালা। মা গো, একদিন তোমার মেয়ে চাকরি করে তোমরা গলায় জড়োয়া সোনার মালা পরাবে ইনশাআল্লাহ।
আঁচলে বাঁধা টাকা দিও
প্রিয় আম্মু,
আমার জীবনে তুমি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে দামি উপহার। ছোটবেলায় যখন জ্বর আর শ্বাসকষ্ট হতো আমার। তোমাকে আর বাবাকে দেখতাম দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে আমাকে নিয়ে। কলেজে পড়াকালীন একবার বাস দুর্ঘটনার মধ্যে আমি ফোন রিসিভ না করাতে ভেবেছিলে আমি বোধহয় ওই বাসে আছি। তখন ছুটে গিয়েছিলে আমার কাছে। আমাকে সুস্থ দেখতে পেয়ে তোমার সে কি আনন্দ। ছুটি শেষে ঢাকা আসার সময় আব্বু পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা দিলেও তুমি তোমার আঁচলে বেঁধে রাখা টাকা দিতে ভুলে যেতে না। পৃথিবীতে কারও জন্য যদি দ্বিতীয়বার বাঁচার স্বপ্ন দেখি সেটা তুমি।
পৃথিবীর সব দুর্গও যদি আমাকে সুরক্ষা দিতে চায় আমি বরং তোমার কোলকেই বেছে নেব। দোয়া করো আম্মু, তোমার ছেলে যেন তোমার মুখ উজ্জ্বল করতে পারে।
তানজিদ মাহমুদ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার সুরক্ষা দেয়াল
প্রিয় মা,
ব্যথার সময় মা মা বলে চিৎকার করলেই ব্যথা কমে যায়। এটা কি সত্যি, না এটা স্রেফ বানানো কথা? এই যে তুমি, মহামতি এক নারী আমার জন্য নশ্বর পৃথিবীর যাবতীয় মায়া-মমতা নিয়ে আমার জন্মের আগে থেকে বসে আছো। সুরক্ষা দেয়াল কিংবা স্নেহের চাদর, তাবত দুনিয়ার শাসন কিংবা আদর, রাত্রি-দিন ক্লান্তিহীন তুমি যেন আলাদিনের সেই জিন। ইট-পাথরে ঘেরা চার দেয়ালটাকে কী এক অকৃত্রিম অনুভূতির চাদরে জড়িয়ে রেখেছ তুমি। আজীবন সবকিছুতে হেরে বসে থাকা আমাকে রাত জেগে ভোর দেখিয়ে জিতিয়ে দিয়েছ। তোমাকে বলা হয় না মা, তোমাকে ছাড়া জীবন ভাবতে পারি না। তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি।
নুসরাত জাহান অমি
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।
ইন্টারনেটটা একটু শেখো
প্রিয় আম্মু,
তুমি হলে আমার স্বস্তির জায়গা। সাহস, ভালোবাসা ও ভরসার জায়গা। কত সহজে তুমি কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো! তুমি পাথরের চেয়েও শক্তিশালী আম্মু। একফোঁটা চোখের পানি না ফেলেও ঠিকই পরিস্থিতি সামলে নাও। মাঝে মাঝে আমাকেও বলো এত নরম মন নিয়ে থাকলে দুনিয়াটা আমার জন্য কত কঠিন হবে। বড় হওয়ার পর মনে হয় ভদ্র হয়ে গেছি। তোমার বকাগুলো তেমন জমে না। আম্মু তুমি পারলে ইন্টারনেটের ব্যবহারটা আরেকটু ভালো করে শিখে নাও। নিজের জন্য সময় বের করো। তুমি বড্ড বেরসিক রয়ে গেছ। টিভিতে বা বাসায় মুভি দেখো। কিন্তু সিনেমা হলে নিতে চাইলে যেতে চাও না। কেন বলো তো? তোমার একমুহূর্তের অনুপস্থিতি আমাকে ভোগায়। বাসায় ঘরভর্তি মানুষের মাঝেও তুমি এক দিনের জন্য কোথাও গেলে আমার ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
ফৌজিয়া আক্তার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
আমার যত পাওয়া সব তোমার অবদান। দেশের নামকরা স্কুলে থেকে নামকরা কলেজ; তোমার সাধনাতেই সম্ভব হয়েছিল। মা তোমাকে চাই জীবনের উত্থান-পতনে, রাগে-দুঃখে, অভিমান-আনন্দে।
জাবিন তাসনীম খান, ইংরেজি বিভাগ, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ
পূর্ণ হয়ে উঠছি
মা, তোমার স্নেহমাখা স্পর্শেই আজ ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠছি। তোমার আদুরে হাত, ডাক, কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি। আমার ভালো থাকার প্রাণান্তকর যে চেষ্টা দেখি তোমার মাঝে, তারপরও মুখ ফুটে বলা হয় না, তোমাকে কতটা ভালোবাসি।
সাফিন আহমেদ, অষ্টম শ্রেণি, ইউনাইটেড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, জামালপুর।
আমার জন্মের সময় দারুণ যন্ত্রণা সহ্য করে যিনি আমায় পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন তিনি আমার আম্মা। আম্মা আমার জীবনের প্রথম বন্ধু যার কাছে মন উজাড় করে ডাকবাক্সের মতো সব কথা জমা রাখা যায়। মা মানেই শত ক্লান্তির মাঝেও শান্তির পরশ।
মোছা. জেরিন ফেরদৌস, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঈশ্বরদী সরকারি কলেজ।
আবার জন্মালে তোমার কোলেই
এক অক্ষরের আর কোনো শব্দে এত গভীরতা ও ভালোবাসা নেই। বছরে শুধু একদিন নয়, তোমার প্রতি ভালোবাসা বছরজুড়ে। আজকের এই বিশেষ দিনে এতটুকুই বলতে চাই ‘আমি যা কিছু পেয়েছি ও যা পাওয়ার আশা করি, সবই তোমার অবদান। যদি আবার জন্মানোর সুযোগ পাই, তবে যেন তোমার কোলেই আমার জন্ম হয়।
কানিজ ফাতেমা লোপা, ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং, মিরপুর কলেজ, ঢাকা।
সব সময় তুমি ঠিক
মামণি,
আমরা দুই বোন সবসময় একটা কথা বলি ‘মামণি ইস অলওয়েজ রাইট’। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে যে তোমার সঙ্গে শুরুতে রায় মেলেনি; কিন্তু গল্পের শেষে দেখা যায় তুমিই সঠিক। মামণি, তুমি আমার দেখা সব থেকে বুদ্ধিমান নারী। আমার মা বলে বলছি তা নয়, ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য করেছি তুমি যে কোনো কঠিন সমস্যার সহজে সমাধান করতে পার। কখনো আবেগ দিয়ে প্রভাবিত হও না। মামণি, তুমি চাইলেই অনেক কিছু হতে পারতে। কিন্তু আমাদের দুজনের মা হওয়াটাকে তুমি বেছে নিয়েছ। মেয়ে বলে কোনোদিন আমাদের নিয়ে স্বপ্ন ছোট দেখনি। পৃথিবী এপার-ওপার করে হলেও আমাদের সাবলম্বী করার লড়াই থামাওনি। আজ যতটুকুই অর্জন করেছি তার সব কৃতিত্ব তোমার।
ফারদিনা ভূঁইয়া,
ঢাকা ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।
তোমার জন্য কেঁদেছিলাম
প্রিয় আম্মু,
আমি তোমার মানিক। তোমার বোধহয় মনে আছে, আমি যখন খুব বেশি দুষ্টামি করছিলাম, পড়াশোনা করতেই চাইছিলাম না, তখন আব্বু আমাকে হোস্টেলে রেখে আসলো। নবম-দশম এই দুই বছর আমি হোস্টেলে বন্দি পড়েছিলাম। তখন তুমি যেমন আমার জন্য কেঁদেছিলে, আমিও কেঁদেছিলাম। সত্যি বলতে আমার প্রতিটি রাতই তোমার কথা মনে পড়ত। কান্না করতে করতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতাম। এটা কখনো বলা হয়নি তোমাকে। আজ কী মনে করে বলেই ফেললাম। আরেকটা কথা—আম্মু তুমি হয়তো জানো না, তুমি কতটা পরিশ্রমী, সাহসী। ৪ ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তুমি যেভাবে একা যুদ্ধ করেছ সে গল্পগুলো দিয়ে চাইলে কয়েকটা উপন্যাস লেখা যাবে। তুমি আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নারী। আমার কাছে তুমিই ডাক্তার, তুমিই সেরা রাঁধুনী, তুমিই শিক্ষক, তুমিই ভালো বন্ধু। একথায় আম্মু তুমি আমার পৃথিবী।
আজহার মাহমুদ
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।
৯৯ শতাংশই মা
প্রিয় মা, আমার পৃথিবীর এক ভাগ বাদবাকি পৃথিবীর জন্য রেখে দিলে ৯৯ শতাংশই তুমি। ছোটবেলার হাজারো অদ্ভুত বায়না থেকে শুরু করে গ্র্যাজুয়েশন পর্যন্ত পুরোটা তোমার ছায়া আমায় ঢেকে আছে। ২৫টি বসন্তের উৎফুল্লতার প্রধান উৎস তুমি। আমার প্রতিটি দিনই তোমাকে ঘিরে। সময় ফুরোবার আগে যত বসন্ত আছি, তার চেয়ে বেশি বসন্ত তোমার হোক।
ফারহানা সুলতানা তাপসী, আইন বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
ভালো থাকুক সব মা
চীনের একটা গল্প আছে। এক প্রেমিকা তার প্রেমিককে বলল, তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিতে চাই। প্রেমিক বলল, কী পরীক্ষা নেবে? প্রেমিকা বলল, তোমার মায়ের হৃৎপিণ্ডটা নিয়ে আসো। প্রেমে অন্ধ ছেলে ছুটল মায়ের কাছে। প্রেমিকার ভালোবাসার পরীক্ষায় পাস করতে মাকে হত্যা করে তার হৃৎপিণ্ড নিয়ে ছুটল প্রেমিকার কাছে। পথে হঠাৎ আছড়ে পড়ল ছেলেটি। হাত থেকে ফসকে গেল মায়ের হৃৎপিণ্ড। ছেলেটি খুঁজে পেয়ে মায়ের হৃৎপিণ্ড হাতে নিতেই ওটা বলল—ব্যথা পেলি খোকা? ভালো থাকুক সব মা। তারা তো হাজারটা কষ্ট সহ্য করেই থাকেন। তবে অন্তত কোনো সন্তানের কারণে যেন তাদের কষ্ট পেতে না হয়।
তৌহিদ বিল্লাহ, নরসিংদী সরকারি কলেজ।