মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক হয়ে গেল পরপর দুই দিন। আশানুরূপ কিছুই হলো না। পরবর্তী বৈঠক কবে হবে, সেই সময় নির্ধারণ হয়নি এবং এক ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে, ১৮ মার্চ জনমনে উৎকণ্ঠা বৃদ্ধি পায়। এদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত জনতা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসভবনে ভিড় জমায়।
এদিকে অসহযোগ আন্দোলনের আজকের দিনে সরকারি-বেসরকারি ভবনের শীর্ষে কালো পতাকা উড়িয়ে, অফিস-আদালত বর্জন ঘোষণার মধ্য দিয়ে সংগ্রামের কর্মসূচিকে সফল করে তোলার আন্দোলন অব্যাহত থাকে। আগের দিন ‘খ’ জোনের সামরিক আইন প্রশাসক যে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন তা প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ। জনগণ ইয়াহিয়ার ‘আলোচনা নাটক’কে আন্দোলন স্তিমিতকরণের কৌশল হিসেবেই ধরে নেয়। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত উৎসুক জনতা তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অবস্থান করতে থাকে এবং স্লোগান তোলে, ‘গোলটেবিল না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। বিপুলসংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে সৌজন্য সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিদেশি এক সাংবাদিক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে আরও সৈন্য আনা হচ্ছে জানিয়ে এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কিছু জানেন কি না জানতে চান। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার দেশের মাটিতে যা কিছু ঘটছে তার সব খবরই আমি রাখি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ন্যাপ (ওয়ালী) প্রধান ওয়ালী খান ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হন।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা তেজগাঁয়ে ও মহাখালীতে শ্রমিকদের ট্রাকে হামলা চালায়। শ্রমিকদের ওপর সেনাবাহিনীর হামলায় রাতে প্রতিবাদ জানিয়ে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির উপনেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম সংবাদপত্রে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, আমরা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই, নিরস্ত্র মানুষের ওপর উসকানিমূলক আচরণ, তা যে কোনো মহলেরই হোক না কেন, আমরা আর সহ্য করব না। চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তিন সদস্যের একটি তদন্ত দল ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যায়। ঢাকায় বিমানবাহিনীর প্রাক্তন বাঙালি সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারের অঙ্গীকার করে।
১৭ মার্চ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠিত হলে আওয়ামী লীগ সেই তদন্ত কমিটি বর্জন করে। বঙ্গবন্ধু বলেন, এই তদন্ত কমিশন চাই নাই। সেইসঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে এই তদন্ত কমিশনের সঙ্গে কোনো রকমের সহযোগিতা না করার আহ্বান জানান তিনি। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন প্রভৃতি শক্তির প্রতি তাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালি হত্যার অপচেষ্টা বন্ধ করার আবেদন জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ অন্য এক বিবৃতিতে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বুদ্ধিজীবীদের কাছে তারবার্তা প্রেরণ করে আসন্ন গণহত্যা ও যুদ্ধ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের নিবৃত্ত করার অনুরোধ জানান। প্রচুর সংখ্যক দেশি-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আগত শপথদীপ্ত সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও সংগঠন অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি অকুণ্ঠ আস্থা জ্ঞাপনপূর্বক নেতার আশীর্বাদ কামনা করেন।