শ ম রেজাউল করিম
১৮ মে ২০২৩, ০৮:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আলোর দিশারি হয়ে এসেছিলেন

তিনি ফিরে এসেছেন দিকভ্রান্ত এক জাতির ক্যাপ্টেন হয়ে। ফিরে এসেছেন ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ বৈরী সময়ে একমাত্র কান্ডারি হয়ে। এসেছেন অন্ধকারে আলোর দিশারি হয়ে। পিতা-মাতা, ভাই ও আত্মীয়-পরিজন হারিয়ে শোকে বিহ্বল থাকার সময়টুকুও তিনি পাননি। স্বদেশের মাটি ও মানুষের অমোঘ ডাক সেদিন উপেক্ষার উপায় জানা ছিল না তার। দিনটি ছিল ১৭ মে, ১৯৮১। রোববার। আর দশটি দিনের মতো রৌদ্রোজ্জ্বল ছিল না সে দিনটি। একদিকে ঝড়-বৃষ্টিতে বৈরী প্রকৃতি আর অন্যদিকে স্বৈরশাসকের রক্তচক্ষু ও ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। এসব কিছুই উপেক্ষা করে তিনি ফিরলেন বীরকন্যা হয়ে বাংলার মাটিতে। তিনি ইতিহাসের কালজয়ী মহামানবের কন্যা, তিনি বাঙালির মুক্তির মহানায়কের যোগ্য উত্তরসূরি। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর সংকল্পে তিনি অবিচল। প্রগাঢ় দেশপ্রেম আর নির্ভীকচিত্ত তাকে পরিণত করেছে দুর্গতদের কণ্ঠস্বরে। নির্যাতিত মানুষের অধিকারের প্রশ্নে তিনি আপসহীন। দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতায় তিনি অনন্য। তিনি শেখ হাসিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা সেদিন বাংলার মাটিতে ফিরে এসেছেন কোটি বাঙালির আশার প্রদীপ হয়ে। তিনি এসেছেন পিতার পথে পথ মিলিয়ে বাঙালি জাতিকে আলোর ঠিকানায় পৌঁছে দিতে। ১৭ মে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানবন্দর পরিণত হয়েছিল জনসমুদ্রে। কী ব্যাকুল প্রতীক্ষা মানুষের! ঠিক যেন বঙ্গবন্ধু ফিরছেন স্বদেশের মাটিতে। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনাকে শুধু একনজর দেখার জন্য ছুটে আসা জনতার কণ্ঠে সেদিন ধ্বনিত হচ্ছিল, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’; ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে আমরা আছি তোমার সাথে’। দিশেহারা বাঙালির দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ছয় বছরের নির্বাসন শেষে স্বদেশের মাটিতে পা রাখলেন শেখ হাসিনা। এদিন দেশের মানুষের ভালোবাসায় আপ্লুত বঙ্গবন্ধুকন্যা সেদিন জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।’ সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমার আর হারানোর কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদের ফিরে পেতে চাই।’ তিনি সেদিন এও বলেছিলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আমি আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী কর্মী হিসেবে আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’ রাজনীতির হাতেখড়ি যার খুব ছোটবেলা থেকে, ছাত্ররাজনীতিতে যার বর্ণাঢ্য বিচরণ আর ধমনিতে যার বঙ্গবন্ধুর রক্ত, তিনি দেশে ফিরে রাজনীতির মূলধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় মনোযোগী হলেন। লড়াই শুরু করলেন জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনে। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার নেতৃত্বে বিপুল ভোটে জয়লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২১ বছর পর পথ হারানো বাংলাদেশ আবার সঠিক পথে চলতে শুরু করে। প্রশাসন ও অন্যান্য স্তরে তখন স্বাধীনতা ও আওয়ামীবিরোধীদের উপস্থিতি সুস্পষ্ট। এমন জঞ্জাল নিয়েই সরকারের দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। দক্ষ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় তখন তিনি সব সামলে নেন। প্রধানমন্ত্রী হয়েই দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বণ্টনে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করেন। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তিচুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে কয়েক দশকের চলমান চরম সংকট নিরসন করে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নেন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০০৮, ২০১৪ এবং সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। সরকারের টানা তিন মেয়াদে বাংলাদেশকে শেখ হাসিনা বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন। তার রাষ্ট্র পরিচালনার মুনশিয়ানায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানব উন্নয়নসহ প্রায় সব সূচকে পাকিস্তানকে অতিক্রমসহ অনেক সূচকে বিশ্বের অনেক দেশ আমরা ছাড়িয়ে গেছি। মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। এটিই অভিজ্ঞ রাজনীতিক ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অনবদ্য সাফল্য। তার মতো নেতৃত্ব পেয়েছি বলেই সব প্রতিকূলতা জয় করে আজ আমরা উন্নয়নশীল বিশ্বে পদার্পণ করছি। উন্নতসমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশে বিনির্মাণের পথে দ্রুতলয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এ দেশের মানুষ আজ সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে। গৃহহীন ও আশ্রয়হীন মানুষ বিনামূল্যে ঘর পাচ্ছে। মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হচ্ছে। বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৯ বিলিয়ন থেকে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, গড়-আয়ু ৪৭ থেকে বেড়েছে ৭৩ বছরে এবং সাক্ষরতার হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ শতাংশের বেশি। খাদ্য উৎপাদন, দারিদ্র্য হ্রাস, উন্নত স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ প্রশমনসহ আর্থসামাজিক খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লাভ করেছে বাংলাদেশ। এ সবকিছু সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর একের পর এক চ্যালেঞ্জ জয় করে বীরদর্পে এগিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। অন্তত ১৯ বার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও দমে যাননি তিনি। সব বাধা-বিপত্তি আর দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র পেছনে ফেলে শেখ হাসিনা অন্ধকার থেকে আলোর পথে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় দেশকে শামিল করেছেন। যিনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারক, লক্ষ্য যার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণ, তার গতি রোধ করার সাধ্য কারও নেই। শেখ হাসিনা শত প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও অবিচল থেকেছেন, হয়েছেন বিজয়ী। এটি বিশ্বের বিস্ময়। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকিসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। সংকট মোকাবিলায় শেখ হাসিনা গোটা বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছে। শেখ হাসিনা আজ বিশ্ব পরিমণ্ডলে দুর্গতদের কণ্ঠস্বর, তিনি প্রাচ্যের নতুন তারকা, তিনি মানবতার জননী, তিনি বিশ্বের অন্যতম সৎ ও পরিশ্রমী প্রধানমন্ত্রী, তিনি বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে অনুপ্রেরণাদায়ী, অনুসরণীয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশে এবং বিশ্ব পরিমণ্ডলে তিনি অনিবার্য। জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার পর শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনর্জন্ম দিয়েছেন। তিনি ফিরে এসে বাঙালি জাতির মুক্তির স্বপ্ন যেমন দেখেছেন, তেমনি বাঙালিকে মুক্তির স্বপ্ন দেখা শিখিয়েছেন। তার আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় স্বৈরতন্ত্রের অবসান শেষে বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন হয়েছে। তিনি এসেছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ পুনরায় প্রতিষ্ঠা হয়েছে; স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের দর্প চূর্ণ হয়েছে। তার মতো অকুতোভয় রাজনীতিক ও মানবিক রাষ্ট্রনায়ক বিশ্বে বিরল। নীতি ও আদর্শে বঙ্গবন্ধুর মতোই দৃঢ় ও সাহসী রাজনীতিক শেখ হাসিনা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কল্যাণে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাচ্ছেন। দীর্ঘ ৪২ বছর দলের প্রধান এবং ২০ বছর দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বদেশে না ফিরলে বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। একজন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গল্প তাই এভাবেই লেখা যায়—অতঃপর তিনি এলেন/তিনি এলেন পিতার পথে পথ মিলিয়ে/আলোর পথ খুঁজে দিতে/তিনি এলেন/রুদ্ধ শেকল ভেঙে, গলিয়ে/জাতিকে আপন করে পেতে।

লেখক : সংসদ সদস্য, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

‘ভিউ’ পেতে নিজের বিমান বিধ্বস্ত করলেন ইউটিউবার

আ.লীগের কাছে ২০টি আসনের প্রত্যাশা জোট শরিকদের

চবিতে ছাত্রীদের ইভটিজিংয়ের অভিযোগে দুই আনসার সদস্য সাময়িক চাকরিচ্যুত

ছিনতাই ও প্রতারণার অভিযোগে পৌর কমিশনার আটক

কাজের মাধ্যমে সবকিছুর প্রমাণ দিতে চাই : সাকিব

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করলেন জি এম কাদের

‘মা আমাকে সরকারি চাকরি করতে বলেন’

টেকনাফ স্থলবন্দরে মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি শুরু

অবরোধ সফলে বনানীতে শ্রাবণের নেতৃত্বে মশাল মিছিল

বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস ২০২৩ / জীবনের উৎস মাটি ও পানিকে অবজ্ঞা ধরিত্রীর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে

১০

আছে ভবন, নেই কার্যক্রম

১১

মানিকগঞ্জে গণধর্ষণের শিকার ২ নারী, গ্রেপ্তার ৭

১২

শাহজাহান ওমরের অনুসারীদের আ.লীগে যোগদান

১৩

মিরপুর টেস্টে নতুন ভূমিকায় দেখা যাবে তামিমকে

১৪

মাল্টা পার্লামেন্টের সামনে বিএনপির বিক্ষোভ 

১৫

প্রাইম ব্যাংকে চাকরির সুযোগ

১৬

আ.লীগ সরকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ : প্রধানমন্ত্রী 

১৭

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত ১৬ হাজার ছুঁইছুঁই

১৮

সর্বোচ্চ করদাতা কণ্ঠশিল্পী তাহসান-রুবেল-মমতাজ

১৯

সাগরের তলদেশে পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল পরিবহন শুরু

২০
X