সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। এরই অংশ হিসেবে সংগঠনকে শক্তিশালী করাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে দলটি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন বিএনপির সংশ্লিষ্ট নেতারা। একই সঙ্গে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে চলমান ১০ দফার আন্দোলনে নেতাকর্মীদের নিরবচ্ছিন্ন অংশগ্রহণ ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে বিভাগভিত্তিক মহানগর/জেলার শীর্ষ নেতা এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট আসনের প্রভাবশালী নেতা ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব বৈঠকে চলমান সংকটকালে সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে আরও ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলা হয়েছে। আগে সরকারের পতন নিশ্চিত এবং পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের চিন্তা করতে নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর আগে এই সরকারের অধীনে যারা নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলবেন বা চিন্তা করছেন, তাদের ক্ষমতাসীনদের দালাল ও সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। সেইসঙ্গে বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় গেলে দলের এখন যারা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও নিপীড়িত, তাদের মূল্যায়ন করার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া আন্দোলন ও সংগঠন নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মহানগর/জেলাসহ ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আন্দোলন সফলে নানা দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। সম্প্রতি লন্ডন সফর শেষে দেশে ফেরা বেশ কয়েকজন নেতার মাধ্যমে কিছু নির্দেশনা তৃণমূলে পৌঁছে দিতে বলেছেন তিনি। কেননা এবার আন্দোলন সফলে মধ্যম সারির নেতাদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অবশ্য কোনো কোনো নেতা জানান, তারা নিজেদের অবস্থান মজবুত ও সম্পর্কোন্নয়ন করতে লন্ডনে গিয়েছেন।
জানা গেছে, গত ১৫ মে জয়পুরহাট, নওগাঁ ও নাটোর, গত ১৬ মে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সভাপতি/সাধারণ সম্পাদক, সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচনী আসনের সাবেক সংসদ সদস্য প্রার্থী বা যারা প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছিলেন এবং আগামীতে মনোনয়নপ্রত্যাশী (স্থানীয় প্রভাবশালী) এমন নেতাদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তাছাড়া গত মঙ্গলবার সব মহানগরীর সভাপতি/আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক/সদস্য সচিবদের নিয়েও বৈঠক করেছেন তিনি। বৈঠকে কোনো কোনো আসনের একাধিক নেতা উপস্থিত ছিলেন।
এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক নেতা আলাপকালে জানান, তারা কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা পেয়েছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন এখন শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর এবং চূড়ান্ত আন্দোলন গড়ে তোলার সময়। এ মুহূর্তে নির্বাচন নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। সেইসঙ্গে যেখানে কমিটি নিয়ে সমস্যা রয়েছে, সেখানে বিভেদ নিরসনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছেন যে, সংগঠন গোছানো একটা চলমান প্রক্রিয়া। আন্দোলন ও দল পুনর্গঠন পাশাপাশি চলবে। কেন্দ্র থেকে সারা দেশে তৃণমূল তথা গ্রামে-গঞ্জে আন্দোলনের তীব্রতা ছড়িয়ে দিতে হবে। আবারও সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সরকারের পতন নিশ্চিত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
রাজশাহী ও নওগাঁ জেলা বিএনপির তিনজন নেতা আলাপকালে জানান, তাদের দলের হাইকমান্ড সাফ জানিয়ে দিয়েছে, আগে সরকারের পতন পরে নির্বাচনের চিন্তা। এর আগে যারা নির্বাচন নিয়ে কথা বলবে, তারা সরকারের দালাল অথবা সুবিধাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হবেন। তাছাড়া প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ থেকে আন্দোলন জোরদার করতে বলা হয়েছে। আমরা নিজেদের সর্বশক্তি দিয়ে সবার আগে এ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করাব। তারপর নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন হবে। কারণ শেখ হাসিনাকে না সরাতে পারলে দেশ ও দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। সবার জন্য টিকে থাকা কঠিন হবে। সবার আগে শেখ হাসিনার পতন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা শুধু বিদেশি বা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দিকে তাকিয়ে থাকব না। আমাদের কর্মকাণ্ডের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সমর্থন ও সাহস দেবেন।
গতকাল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশের চলমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে বিদায়ের কোনো বিকল্প নেই। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা বারবার অত্যন্ত পরিষ্কার ও দৃঢ়ভাবে বলছি যে, এ সরকার থাকলে কোনো নির্বাচন হবে না। হাসিনা সরকার থাকলে কোনো নির্বাচন হবে না। একটা নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হতে হবে।
মধ্যমসারির নেতাদের লন্ডন দৌড়ঝাঁপ জানা গেছে, ঈদুল ফিতরের আগে-পরে বিএনপির মধ্যমসারির বেশকিছু নেতা যুক্তরাজ্য সফর করেছেন। কমবেশি সবাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। আরও কিছু নেতা যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। এরই মধ্যে লন্ডনে যাতায়াতকারী নেতাদের উল্লেখযোগ্য হলেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য সচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামান, প্রশিক্ষণবিষয়ক সহসম্পাদক ও মিডিয়া সেলের সদস্য অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক সভাপতি এমএ কাইয়ুম, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির বর্তমান সদস্য সচিব আমিনুল হক, ঢাকা দক্ষিণের বিএনপির মেয়র প্রার্থী ও মহানগরীর সদস্য প্রকৌশলী ইশরাক হোসেনসহ অর্ধশতাধিক নেতা। আরও কয়েকটি জেলার নেতারা লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিএনপির বাইরে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থও বিএনপির শীর্ষ নেতার সঙ্গে দেখা করেছেন। অনেকেই তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। সেখানে তার হাস্যোজ্জ্বল ছবি দেখে নিজ নিজ এলাকার অনুসারীরাও শেয়ার করেছেন।
এসব নেতার মধ্যে কয়েকজন জানান, তারা মূলত চলমান আন্দোলন ও নির্বাচন ইস্যুতে তারেক রহমানের সঙ্গে দেখা করে শারীরিক খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি কথা বলে তার মনোভাব সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনাও পেয়েছেন। বর্তমান সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনে না যাওয়ার বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত এবং কঠোর আন্দোলনের বার্তা দিয়ে তা সফল করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্দেশনাও পেয়েছেন।
সম্প্রতি লন্ডন সফর শেষে দেশে ফিরেছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমরা সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ দশ দফা দাবিতে আন্দোলনের মধ্যে আছি। আন্দোলনের নির্দিষ্ট কোনো দিনক্ষণ হয় না। চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে আবারও এই সরকারের পতনের লক্ষ্যে তৃণমূলে কর্মসূচি দিয়েছি। এভাবে সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনের একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি করতে চাই। এ ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। নির্দেশনা অনুযায়ী জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলনের জন্যই আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।