মৃত্তিকা সাহা
প্রকাশ : ২২ মে ২০২৩, ০৮:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আইএমএফের শর্ত মেনে আসছে নতুন মুদ্রানীতি

আইএমএফের শর্ত মেনে আসছে নতুন মুদ্রানীতি
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নকে প্রাধান্য দিয়ে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ লক্ষ্যে আগের মুদ্রানীতিগুলোর তুলনায় নতুন মুদ্রানীতির কাঠামোগত পদক্ষেপে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাবে। এ পরিবর্তন আনার উদ্দেশ্যই হলো মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সরকার নির্ধারিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা দেওয়া। আগামী ১৮-২০ জুনের মধ্যে এই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। খবর বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সংশ্লিষ্ট সূত্রের। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, আগামী মুদ্রানীতিতে বড় পরিবর্তন দেখা যাবে নীতি সুদহারের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ রেপোর ওপরে ও নিচে একটি নির্দিষ্ট করিডোর দেওয়া হবে। নিচেরটার বিনিময়ে ব্যাংকগুলো আমানত রাখতে পারবে এবং উপরেরটার বিনিময়ে ব্যাংকগুলো প্রচলিত নিয়মে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নিতে পারবে। এর মাধ্যমে মানি মার্কেট রেটটাকে স্থিতিশীল রাখা হবে। ব্যাংকগুলোর ঋণের সুদহার নিয়ন্ত্রণেই এটি করা হচ্ছে। ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যে ব্যবস্থায় টাকা ধার নেয়, সেটিই রেপো নামে পরিচিত। এবারের মুদ্রানীতির মূল ফোকাস হবে সুদহার নিয়ন্ত্রণ। ঋণে বেঁধে দেওয়া সুদহারের পরিবর্তে করিডোর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ মনিটরি টার্গেটিংয়ের পরিবর্তে এখন থেকে ইন্টারেস্ট রেট টার্গেটিংয়ের দিকে যাত্রা করছে। যা প্রয়োগ করে বাংলাদেশ ব্যাংক মূল্যস্ফীতিকেও প্রত্যাশিত মাত্রায় রাখতে চায়। এই পদ্ধতি ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া) ২০১৬ সাল থেকেই মেনে চলছে। এটিকে বলা হচ্ছে মনিটরি পলিসি ফ্রেমওয়ার্কের আধুনিকায়ন। এ ছাড়া আসছে মুদ্রানীতিতে প্রথমবারের মতো একক বিনিময় হার নির্ধারণের ঘোষণা থাকবে। একইভাবে রিজার্ভ হিসাব পদ্ধতি আইএমএফ নির্দেশিত পন্থায় নির্ধারণ করারও ঘোষণা দেওয়া হবে এই মুদ্রানীতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এ বিষয়ে তাদের কার্যক্রম প্রায় শেষ করেছেন। এখন রীতি অনুযায়ী, বিভিন্ন অংশীজনের মতামত নেওয়া হবে। মুদ্রানীতি নিয়ে গতকাল রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সভাপতিত্ব করেন। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরবৃন্দ, নির্বাহী পরিচালকবৃন্দসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্তিত ছিলেন। বৈঠকে মুদ্রানীতিতে নেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিবর্তনগুলো তুলে ধরা হয়। এ সময় গভর্নর বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে মুদ্রানীতিতে। এরই ধারাবাহিকতায় আগামী ২৪ মে দেশের থিঙ্কট্যাঙ্কসহ অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ নেওয়া হবে। আর ২৫ মে দেশের ব্যবসায়ী শ্রেণিপেশাসহ অন্যদের মতামত নেওয়া হবে বলে জানা গেছে। গত জুলাইয়ে গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এটি হবে আব্দুর রউফ তালুকদারের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি। এর আগের গভর্নর ফজলে কবিরের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাঝে কিছুদিন বছরে একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করার প্রচলন করা হলেও আইএমএফের পরামর্শে এখন আবার ছয় মাস অন্তর মুদ্রানীতি ঘোষণার পথে ফিরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক এমন সময়ে মুদ্রানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করছে, যখন টাকার মান কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতির পারদ প্রায় দুই অঙ্কের কাছাকাছি, ব্যাংকিং খাত রয়েছে তারল্য সংকটের চাপে। এক বছর ধরে বিদেশি মুদ্রার সরবরাহে টান রয়েছে, লেনদেন ভারসাম্যেও বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে। রাজস্ব আদায় আশানুরূপ না হওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে সরকারের, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিতে পারে। টাকা মান হারাতে শুরু করায় ডলার সাশ্রয়ে গত বছর জুলাই মাসে আমদানিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, এখনো তা অব্যাহত রাখা হয়েছে। আমদানি কমে গত বছরের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এলেও বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়নি। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতি হারিয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এসব সূচকে পরিবর্তন এনে নতুন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে; তার প্রভাব কেমন হবে, তা বুঝতে চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। এই প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে শুধু ‘টার্গেট’ দিলেই হবে না, কীভাবে কমানো হবে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে; কেন কমছে, সেই বিষয়ে তিনি বলেন, আগামী মুদ্রানীতিতে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তিনি আরও বলেন, সুদহার বেঁধে না দিয়ে বাজারমুখী করতে হবে। বাজার যে সুদহার তৈরি করে, তা হতে দিতে হবে। এজন্য বাজারকে বিশ্বাস করতে হবে। এখানে ম্যানিপুলেট করলে তা কার্যকর হবে না। সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানো আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে জানিয়ে আহসান মনসুর বলেন, সরকারের অর্থায়ন কোন উৎস থেকে হবে, তা আগামী মুদ্রানীতিতে স্পষ্ট করতে হবে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে যদি হয়, তাহলে কি নতুন টাকা ছাপিয়ে করবে, সে বিষয়ে পরিকল্পনা থাকতে হবে। শুধু নীতিমালা প্রকাশ না করে তা কার্যকর করতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান আহসান মনসুর। এর আগে চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি নীতি সুদহার বাড়িয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) জন্য ‘সতর্ক ও সংকুলানমুখী’ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারি-জুন ২০২৩ সময়ের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতির সময় পার হয়েছে সাড়ে চার মাস। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক বিভিন্ন সূচকের তথ্য প্রকাশ করেছে মার্চ পর্যন্ত। কোনো কোনোটি আবার ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। সেই তথ্য অনুযায়ী, চলমান মুদ্রানীতিতে ব্যাপক মুদ্রা (এম২) প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। গত মার্চে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। মুদ্রানীতিতে সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ, গত মার্চ পর্যন্ত হয়েছে ৩৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, সেখানে গত মার্চ শেষে অর্জন হয়েছে ১২ দশমিক ০৩ শতাংশ। সব মিলিয়ে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, মার্চ পর্যন্ত যা হয়েছে ১৬ দশমিক ২১ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রেখে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসাবে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। আর সাময়িক হিসাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে হয়েছে ৬ দশমিক ০৩ শতাংশ। আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। সেই সঙ্গে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেন, বাস্তবতার সঙ্গে মিল না থাকলেও এসব লক্ষ্যমাত্রাকে ধরেই বাংলাদেশ ব্যাংকের আগামী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হচ্ছে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে আমরা মিলেমিশে থাকব : এ্যানি

১৮ বছর পর বল গড়াল শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে 

ডা. মোস্তফা হাজেরা ফাউন্ডেশনের ১০ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

রাতে অন্তর্বাস পরে ঘুমানো : যে কারণে ক্ষতিকর

কলরেট কমানো-মেয়াদবিহীন ইন্টারনেট চালুর পক্ষে ৯৬ শতাংশ মানুষ

ঢাবির জগন্নাথ হলে নবনির্মিত দুই ভবন উদ্বোধন

ঢাবির ভর্তিতে পোষ্য ও খেলোয়াড় কোটা বাতিলে রিট

‘আমার ছেলেকে হত্যা করেছে ছাত্রলীগের কুলাঙ্গাররা’

সাভারে চেকপোস্ট বসিয়ে পুলিশের তল্লাশি

আমরা লোকালাইজেশনের জন্য কমিউনিটির প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ

১০

ষড়যন্ত্র প্রতিহতে রাজধানীতে এলডিপির মিছিল

১১

অবৈধ মবিল রিফাইনিং কারখানায় অগ্নিকাণ্ড

১২

ইউজিসির বৈষম্য নীতির প্রতিবাদে জবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিল

১৩

গ্র্যামির মনোনয়নে নারী শিল্পীদের দাপট

১৪

আবারও এক হয়ে মাঠে নামছেন কিম-পুতিন

১৫

নিয়োগ দিচ্ছে আবুল খায়ের গ্রুপ

১৬

‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়বে জামায়াত’ 

১৭

লোকালয়ে মিলল ১০ ফুট লম্বা অজগর

১৮

অধ্যক্ষকে সরিয়ে চেয়ার দখল করলেন বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা

১৯

বাংলাদেশের আইটি ফার্ম সফটনার্সারির সঙ্গে যুক্ত হলো ওয়াশিংটন ডিসি সরকার

২০
X