আগামী সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে বিদেশি কূটনীতিকদের তৎপরতা। আমাদের দেশে এটা নতুন কোনো বিষয় নয়। নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনীতিকদের এ প্রবণতা আমরা অনেক দিন ধরেই প্রত্যক্ষ করছি। এবারও তারা দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন ও নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠকে সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সহিংসতামুক্ত এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার আহ্বান জানাচ্ছেন। নানা পরামর্শের পাশাপাশি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সহযোগিতাও দিতে চাইছেন।
দেড় দশকের বেশি সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি নিয়ে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করছে। সরকারি দল আওয়ামী লীগও ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে নানা কৌশল নির্ধারণের পাশাপাশি এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার অটল অবস্থান ঘোষণা করে পাল্টা কর্মসূচি দিচ্ছে। অন্যদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে শক্তিশালী দেশের কূটনীতিকরা আমাদের দেশে আসছেন। আবার ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরাও তৎপরতা বাড়িয়েছেন। বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে শুধু বিরোধী দল বিএনপির নেতারা দেখা-সাক্ষাৎ করছেন, তা নয়। সরকারি দল আওয়ামী লীগও আনুষ্ঠানিকভাবেই কথা বলছে। বোঝা যাচ্ছে, আগামী নির্বাচন নিয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে আগ্রহ সমান। বিদেশিরা প্রায় সবাই যে আগামী নির্বাচনটা অংশগ্রহণমূলক হোক সেটা চাইছে, তাতে কারও কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশের মানুষও একটি ভালো নির্বাচন দেখতে চায়। সব দল নির্বাচনে আসুক, ভোটাররা নিজ নিজ পছন্দের প্রার্থীকে সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না হন, প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী প্রচার-প্রচারণার বাধামুক্ত সমান সুযোগ পান—এসব চাওয়া নিয়ে কোনো বিতর্ক থাকার কথা নয়।
কিন্তু বিতর্ক আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আছে সমঝোতার ঘাটতি। সব দল একমত হয়ে চলবে—সেটা প্রত্যাশিত না হলেও মোটা দাগে কিছু বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য না থাকলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে না। আমাদের দেশ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতার বাইরে থাকা দল এক ভাষায় কথা বলে না। দেশে অসংখ্য রাজনৈতিক দল থাকলেও মূলত দুই দলের হাতেই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাজনীতি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—এই দুই দলের মধ্যে মতৈক্য হলে অন্য দলগুলো বড় সংকট তৈরি করার সক্ষমতা রাখে না। আগামী নির্বাচন যদি আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে বিএনপি তাতে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি চায় একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী সেটা সম্ভব নয়। তাই বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনে নেমেছে। সংকট সেখানেই। আর এ সুযোগটিই নিচ্ছেন বিদেশি কূটনীতিকরা।
আমরা মনে করি, আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বিদেশি কূটনীতিকদের অনাহূত হস্তক্ষেপ কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যে কোনো দেশের কূটনীতিকদের আচরণগত একটা সীমারেখা আছে, আবার প্রতিটি দেশেরও নিজস্ব একটা স্বকীয়তা আছে। এ বিষয়টি আমাদের সবাইকে বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। আর আমাদের দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থা নির্বাচনের দায়িত্ব জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর। আমাদের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। অব্যাহত থাকবে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।