যে কোনো কিছুতে বিভেদ সৃষ্টির বাতিকগ্রস্তরা সম্প্রতি আবারও উতলা। বিভেদ না থাকলে এরা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। অকর্মণ্য বা কর্মহীন হয়ে যায়। অস্থি-মজ্জায় বিকৃত এ মহলটির অপতৎপরতার সম্প্রতি আরও বিস্তার ঘটছে। মাঝেমধ্যে ঘটনাচক্রে দু-একটির প্রকাশ ঘটছে বিস্ফোরণের মতো। শুধু অন্য ধর্মের সঙ্গে সংঘাত নয়, নিজ ধর্মের মধ্যেও বিভেদ-বিরোধ বাধানোর হেন আয়োজন নেই, যা এরা না করছে।
আলাদা ধর্মে বিশ্বাসও আলাদা। চর্চাও আলাদা। বাংলাদেশের সংবিধানে তা স্পষ্টভাবে স্বীকৃত ও গ্রাহ্য। সংবিধান সব ধর্ম পালনের মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত করেছে। এককথায় যাকে বলে ধর্মনিরপেক্ষতা। রাষ্ট্র কোনো সম্প্রদায়কে মুসলিম-অমুসলিম, ধার্মিক-অধার্মিক ইত্যাদি নামে আলাদা বিবেচনা করে না। করতে পারে না। এটি রাষ্ট্রের সনদ, অঙ্গীকার। ধর্মীয় এ সৌন্দর্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতারও অন্যতম চেতনা। কিন্তু মতলববাজ একটি চক্র অন্য ধর্মের সঙ্গে তুলনা ও বিরোধ-সংঘাত বাধিয়েই ক্ষ্যান্ত নয়। এরা নানা ছুতায় নিজ ধর্মের মধ্যেও নানা গণ্ডগোল পাকাচ্ছে। ওহাবি-সুন্নি, মোহাম্মদি-আহাম্মদি, শরীয়তি-মারফতি, কাদিয়ানি-কাফের, কিয়ামি-লাকিয়ামিসহ বেশুমার উইন্ডো খুলছে। মাঝেমধ্যে দমে। আবার চাগাড় দেওয়ার মতো মাঠে নামে নানা ছুতায়। নিজ ধর্মও নিরাপদ নয় এদের হাতে। এদের উদ্দেশ্য বুঝতে গবেষক-বিশ্লেষক হওয়া জরুরি নয়। সাদা চোখেই তাদের উদ্দেশ্য বোধগম্য।
‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে ‘ধর্মহীনতা’ অর্থ দাঁড় করানোর একটি নোংরা-সূক্ষ্ম অপচেষ্টা চলে আসছে অনেক দিন থেকে। মৌসুম দৃষ্টে এর তারতম্য হয়। এমনিতেই অন্য ধর্মের সঙ্গে সম্প্রীতি তাদের অপছন্দ। তার ওপর নিজ ধর্মের প্রীতি-সম্প্রীতিও তাদের অসহ্য। ভেজাল না থাকলে তাদের অস্তিত্বও থাকে না। এর সঙ্গে তাদের কারও কারও অর্থনৈতিক সংযোগও রয়েছে। গত ক’দিন তারা পুরোনো স্টাইলে মাঠ গরমের চেষ্টা করেছে কাদিয়ানি ইস্যুতে। পঞ্চগড়ে মধ্যম পর্যায়ের দাঙ্গা প্রায় বাধিয়ে ফেলেছিল। পুলিশ, র্যাব, বিজিবিসহ প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ও সাধারণ মানুষের সচেতনতায় আপাতত মাঠে মারা গেছে তাদের কুপরিকল্পনা। তবে ‘দমে’ গেছে বা ‘নাই’ হয়ে গেছে বলার অবস্থা নেই। রমজান সামনে রেখে তারাবির নামাজ ৮ রাকাত না ২০ রাকাত, রোজা-ঈদ ভিন্ন তারিখে উত্তম, না মক্কা-মদিনার সঙ্গে মিল রেখে অভিন্ন তারিখে উত্তম—এ ধরনের প্রশ্ন বাজারজাত করে বিতর্ক পাকানোর অপচেষ্টায় নেমেছে। এ ছাড়া মিলাদ জায়েজ না না-জায়েজ, নামাজের পর মোনাজাত হালাল না হারাম—এ ধরনের বহু বিষয় তাদের স্টকে থাকে। হিজাব-বোরকা, লম্বা দাড়ি-চাপ দাড়ি, গোল টুপি-কিস্তি টুপি, মূর্তি-ভাস্কর্য ইত্যাদি সাবজেক্ট চর্চা তো আছেই। সুযোগ বুঝে একেকটা মাঠে ছেড়ে বিরোধ পাকায়। কুলাতে না পারলে দম নেয়। তাদের পাকানো গণ্ডগোল সামলাতে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক ঘাম ঝরে। আসল দায়িত্ব ফেলে সময় দিতে হয় বাড়তি ভেজালে, যা জানেন শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভুক্তভোগীরাই।
অন্য ধর্মের তাজা বিষয় হাতে না থাকলে স্বধর্মীয় বিষয়াদিতে ধর্মপ্রাণদের বিভ্রান্ত করার এ চক্রটি সাম্প্রতিক সময়ে কোন উদ্দেশ্যে আবার তৎপর, তা নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদের তারা ‘বিধর্মী’ নামে ডাকতে অভ্যস্ত, যা না টেকে যুক্তিতে, না দলিলে। সব ধর্মে বিশ্বাসীরাই ধার্মিক, মোটেই বিধর্মী নয়। আমাদের সংবিধানও সব ধর্ম পালন নিশ্চিত করেছে। কোনো ধর্মেই বিশ্বাস না করার ‘অধার্মিক’ জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে নেই। তাদের প্রতিও নির্দয় হওয়া সংবিধান অনুমোদন করে না। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এরও এ বিষয়ে পরিষ্কার নির্দেশনা রয়েছে। তার দেওয়া নির্দেশনা মানলে বিশ্বাস করতে হবে—ধর্ম আলাদা হতে পারে, মানুষ আলাদা নয়। কারও সঙ্গে ধর্ম না মিললে তাকে যেন মানুষের বাইরে ভাবা না হয়—সেই তাগিদ দিয়ে গেছেন তিনি।
বাংলাদেশ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই সব ধর্মের সামাজিক সম্প্রীতিতে অভ্যস্ত। হিন্দুর পোষা গরু মুসলমানের কোরবানিতে জবাই হয়। হিন্দু কারিগর বা দোকানির মিষ্টি মুসলমানের মিলাদে বিলানো হয়। মুসলমানের গরুর দুধ, দোকানের কাপড়, গহনায় পূজা করে হিন্দু সম্প্রদায়। মাঝেমধ্যেই এতে ছেদ ফেলানোর অপচেষ্টায় গণ্ডগোল পাকানো হয়েছে। দাঙ্গাও বাধানো হয়েছে। পরিণাম কারও জন্য ভালো হয়নি। এসব করলে যে গোটা লোকালয়কে অশান্তি ভুগতে হয়, তা যুগে যুগে প্রমাণিত। লোকালয়ে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায় না—তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে এ দেশ। মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে মানুষে মানুষে খুনোখুনি, ধর্ম-বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ সতর্কতা দিয়ে গেছেন। ইসলামের ইতিহাসে বিদায় হজের ভাষণ এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ওই ভাষণের বেশ কিছু অংশজুড়ে ছিল শান্তি-সম্প্রীতির কথা। তিনি পরমতসহিষ্ণুতা চর্চাকে ধার্য করেছেন আদেশ হিসেবে। ধর্মে ধর্মে, মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিকে ইসলামের পরিভাষায় বলা হয় ‘ফেতনা’।
যে কোনো ধর্মের কথা বলার অধিকার আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনে বলবৎ। ইসলাম ধর্মে শুধু স্বীকৃত নয়, অনুমোদিতও। বলা হয়েছে গ্রহণ-বর্জন যার যার স্বাধীনতা। তা না মানাকে ফেতনা বলেছেন মহানবী। ধর্মে বিরোধ-জবরদস্তি পবিত্র কোরআনে বারণ করা হয়েছে শক্ত ভাষায় (সুরা বাকারাহ ২৪৬)। ফেতনা বা বিরোধ বাধানোকে ‘হত্যা অপেক্ষা জঘন্য’ (বাকারাহ ১৯১, ২১৭) বলা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এ চর্চার বিস্তার ঘটানো হচ্ছে নানা ইস্যুতে। যাদের এ ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির দায়িত্ব বেশি, সেই আলেম সমাজের কিছু ব্যক্তিও জড়িয়ে পড়ছেন এ কুকর্মে। যার দগদগে নমুনা দেখা যাচ্ছে প্রচারিত ওয়াজের ময়দানে। সেখানেও এখন ময়দান লাগছে না। সেই ময়দান করে ফেলা হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়াকে। বাংলা ভাষায় যখন ইসলামী বইপুস্তক ব্যাপকভাবে রচিত হয়নি, তখন সাধারণ মুসলমানরা এই ওয়াজিন, পীর ও আওলিয়াদের ওয়াজ-বয়ান থেকেই ধর্মীয় জ্ঞান নিতেন। ধ্যানে-জ্ঞানে ওয়াজে মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ করার বয়ান দিতেন আলেমরা। দিতেন ইহকাল-পরকালের সুন্দর তালিম। সেসব ওয়াজে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর আজকের নমুনা ছিল না।
বাজারে চলমান ওয়াজের বেশিরভাগের মধ্যেই ধর্ম প্রচারের বদলে বিরোধ বাধানোর যারপরনাই চেষ্টা। এতে সর্বনাশ হচ্ছে ইসলামসহ সব ধর্মেরই। ইসলাম ধর্মের রূপ-সৌন্দর্য ও গুরুত্বকে তারা খেলা করার পাশাপাশি অন্য ধর্মগুলোকে তাচ্ছিল্য শুধু নয়, অবজ্ঞা করছেন নিকৃষ্টমানে। বিদ্বেষও ছড়াচ্ছেন। এই কর্মে চড়া হাদিয়ায় মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক ওয়াজিন। তাদের কারও কারও তোফা বা হাদিয়ার অঙ্ক বিশাল। কয়েকজনকে মাহফিলে নিতে হয় হেলিকপ্টারে। একসময় শীতকালকে মৌসুম মনে করা হলেও এখন বৃষ্টি, রোদ, গরমেও ওয়াজের ধুম। ফেসবুক, ইউটিউবেও তাদের বাজার রমরমা। শুধু গ্রামগঞ্জে নয়, শহরাঞ্চলেও এবার ওয়াজের আওয়াজ তুঙ্গে। কখনো কখনো তা যাত্রাপালা, সার্কাস, সিনেমার ভাঁড় ও জোকারদের হার মানায়। তাদের অতিকথন, গানের টান, কনসার্ট ধাঁচের জিকির বরবাদ করে ছাড়ছে ইসলামের মূল সৌন্দর্যকে। ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাদের কয়েকজনের। হাসি-ঠাট্টা, মশকরা-তামাশা করেন সমানে। ইউটিউব খুললেই তাদের আসর। মিলিয়ন শ্রোতা-দর্শক।
হিন্দি ও লোকগানের সুরে বাড়তি বিনোদন তাদের ওয়াজে। সেটা করতে গিয়ে মিথ্যাচার, বানোয়াট গল্প, কিচ্ছা। ভাঁড়ামি, গান, অভিনয়, ব্যঙ্গসহ অসংলগ্ন মন্তব্য, অশালীনতা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। মনগড়া মিথ্যাচারকেও সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছেন তারা। কেউ বাদ সাধছেন না। উপরন্তু ভাবাবেগে সমর্থন জোগাচ্ছেন। নামের আগে-পরে আফসারি, তাহেরী, আব্বাসী, মাদানি, মক্কি, মিশরী, আজহারী, জেহাদি, নূরানি, যশোরী, চাঁদপুরী, ভৈরবী, শরীয়তপুরী, জাহেরী, আনসারী ইত্যাদি যোগ করা কথিত বক্তারা রসিয়ে রসিয়ে কমিকের স্টাইল তৈরি করে নিয়েছেন। ফলোয়ার্সও প্রচুর। এই আল্লামা, শায়খুল হাদিস, মুফাসসিরে কোরআন, মুফতি, মুহাদ্দিসসহ বহু বিশেষণধারীদের ওয়াজ এখন শুধু রাতে নয়, দিনেও চলছে। সকাল-দুপুর-বিকেল বিভিন্ন বেলায়ও হয়। ধর্ম, সম্প্রদায়, নারীসহ বিভিন্ন বিষয়ে হেন কদাকার কথা নেই যা তারা রসিয়ে রসিয়ে না বলছেন।
ওয়াজের ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার কন্ট্রাক্ট আয়ের নতুন খাত। পাশাপাশি মাইক-ডেকোরেটর ব্যবসাও। ভিডিও প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে কাজ আসছে। ওয়াজ-মাহফিলকে হামদ-নাত ও ধর্মীয় উৎসাহব্যঞ্জক গান পরিবেশনকারী শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এ উছিলায় তাদেরও বেশ আয়-রোজগার। মানুষকে বিভাজিত তথা ফেতনায় রাখতে দলাদলি ও তরিকা তৈরিও চলে গেছে ব্যবসার পর্যায়ে। ঠান্ডা মাথায় ওহাবি, সুন্নি, দেওবন্দি, মাজারি, বাজারি, খানকাপন্থি, তাবলিগি, কেয়ামি-লাকেয়ামি ইত্যাদি বিভক্তি তৈরি করা হয়েছে। তাদের অনুসারীও অগুনতি। ভক্ত-অনুসারীদের কখনো কখনো মারামারিতেও জড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। এ নিয়ে মামলাবাজির ঘটনাও ঘটছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কয়েকজনকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নজরদারিতে রাখার বার্তাও দেওয়া হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনকে। কিন্তু এর ফলোআপ নেই। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক সম্পৃক্তায় এরা আরও আগোয়ান। সামনে নির্বাচন। রাজনীতির মাঠ গরমের মধ্যে তারাও তেতে উঠছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে মিতালি পাতছেন। কোথাও কোথাও জনপ্রতিনিধিরাও গিয়ে উঠছেন এসব ওয়াজের মঞ্চে। খরচ করে রাজনৈতিক সমাবেশ আয়োজনের চেয়ে ওয়াজ-মাহফিলের রেডিমেট জমায়েতকে লাভজনক ভাবেন এই শ্রেণির রাজনীতিকরা। এর মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে সর্বনাশকে আলিঙ্গন করা হচ্ছে। এটি মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। বিশেষ করে সম্প্রীতির প্রশ্নে বড় বিপজ্জনক।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন