রাব্বানী রাব্বি
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০২:২৯ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গানে-সুরে সোনার মানুষ

গানে-সুরে সোনার মানুষ
‘আরে হাতে লাগে ব্যথা রে/ হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরারে’—এমন কথায় গাঁথা যমুনাপাড়ের লোকগানটি সম্প্রতি কোক স্টুডিও বাংলায় উঠে এসেছে ‘দেওরা’ শিরোনামে। অন্তরাটি গেয়েছেন ইসলাম উদ্দীন পালাকার। ফিউশন ধাঁচের এ গানে শুরুটা করেছেন প্রীতম হাসান। গেয়েছেন ‘এত সুরে রঙিন সোনার তরী’। তরুণ এ সংগীতপরিচালকের সঙ্গে যৌথভাবে গানটির লিরিক লিখেছেন ফজলু মাঝি (ফজলুল হক)। ব্যাক ভোকালে রয়েছেন আরমীন মুসা ও তার ‘ঘাসফড়িং কয়্যার’। কোক স্টুডিওর এ গানে শ্রোতামহলে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন প্রীতম হাসান, ইসলাম উদ্দীন পালাকার ও ফজলু মাঝি। গানটি নিয়ে জানিয়েছেন তারা তাদের অনুভূতি। লিখেছেন রাব্বানী রাব্বি। কে এই পালাকার সিরাজগঞ্জ-পাবনা-রাজশাহী অঞ্চলে নৌকাবাইচে ‘দেওরা’ গানে কণ্ঠ ধরেন মাঝিরা। এবার কোক স্টুডিওর এ গানে ইসলাম উদ্দীন পালাকারের গলায় শোনা গেল সম্মোহিত সেই সুর। এই শিল্পীর বেড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাদ গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সংগীতজগতের মানুষ। এরপর বাউলশিল্পী কুদ্দুস বয়াতির কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন। তার বাড়িতে থেকে গান শিখেছেন দীর্ঘদিন। গানে গানেও ওস্তাদের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন ইসলাম উদ্দীন। গেয়েছেন—‘আমার ওস্তাদেরও চরণ মানলাম দাঁড়াইয়া আসরে/ আমার শিক্ষাগুরু কুদ্দুস মিয়া জানাইলাম আসরে’। ওস্তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া প্রসঙ্গে এই শিল্পীর ভাষ্য, ‘ছোট থেকেই আমি একটু সংস্কৃতিমনা। এলাকায় ঝুমুর যাত্রাপালা হইলে সেখানে অভিনয় করতাম। একবার ওস্তাদ কুদ্দুস বয়াতি আমাদের এলাকায় পারফর্ম করতে এলেন, তখন পালাগান শুনে আমিও চিন্তা করতে থাকি পালাগান গাইব। ১৯৮৮ সালে উনার বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া চলে গেলাম। ওস্তাদের বাড়িতে ছিলাম প্রায় ৯ মাস। এই সময়ে তিনি গ্রামেগঞ্জে যেখানেই পারফর্ম করেছেন, উনার সঙ্গে আমি ছিলাম। বাড়ি কিংবা মঞ্চে যেখানেই পালাগান করতেন, আমি দেখতাম, শিখতাম। এই দেখা-শেখা থেকেই আমার পালাগানের হাতেখড়ি।’ বাউলশিল্পী কুদ্দুস বয়াতির আশীর্বাদ নিয়ে বাড়ি ফিরে নিজেই একটি গানের দল গঠন করেন ইসলাম উদ্দীন। নামটা ‘ইসলাম উদ্দীন ও তার গানের দল’। শুরু হয় পালাগানে তার পথচলা। সুনাম ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলার পাশাপাশি মঞ্চ মাতিয়েছেন রাজধানীর ফোক ফেস্টিভ্যালে। শুধু তাই নয়, পারফর্ম করেছেন লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ উৎসবেও। এবার কোক স্টুডিও দিয়ে সেই পরিচিতির জোয়ার আরও বেড়েছে। কেমন সাড়া পাচ্ছেন—জানতে চাইলে ইসলাম উদ্দীন পালাকার বলেন, ‘আগেও আমাকে লোকজন চিনতেন, কিন্তু কোক স্টুডিওতে গাওয়ার পর যেন আরও অন্যরকম হয়ে গেছে। দিন-রাত ফোন আসছে। পরিচিতরা জানাচ্ছেন তারা আমার গান শুনছেন। এতে আমারও খুশি লাগছে। কোক স্টুডিওর প্রীতম ভাই ও সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা।’ ইসলাম উদ্দীন পালাকার কিশোরগঞ্জেই থাকেন। এখন চলছে গানের মৌসুম। অনেক জায়গা থেকেই পালাগানের প্রস্তাব পাচ্ছেন। তবে পালাকার রয়েছেন দ্বিধায়। বললেন, ‘আগে যেমন গ্রামেগঞ্জে পালাগানের আসর হতো, এখন সেই তুলনায় একটু কম হচ্ছে। গান করতে গেলে উন্নত যন্ত্রপাতি লাগে, না হলে মানুষ শোনে না। তাই আমিও প্রোগ্রাম বেছে বেছে করছি।’ প্রসঙ্গত, ইসলাম উদ্দীন শুধু গান গাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নন, তিনি গীতিকারও। প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে। সবাই তাজ্জব! ‘এলাকায় আমি কিন্তু বেশ জনপ্রিয়। এক ভাইয়ের মাধ্যমে কোক স্টুডিও আমার গান দেখেছে। যখন ঢাকা-কোক স্টুডিও থেকে অফার দেওয়া হয়, তখন গ্রামের মানুষজন আমাকে ঢাকাতেই যাইতে দিতে চাইছিলেন না। অনেকে বলছে, ওনারা তোমাকে নিয়ে গিয়ে বেচে দিবে, ক্রাইম করবে—একেকজন একেক কথা বলছেন। আর আমিও প্রথমে যেতে চাইছিলাম না। অনেকদিন ‘না’ বলছি, ওনাদের সঙ্গে আমার গ্রামের এক বড় ভাইও আসছিলেন, উনি বললেন, ফজলু ভাই যা হবার হবি! চলেন যাই ঢাকা ঘুরি আসি, ঢাকার সব মানুষ খারাপ না, অনেক ভালো মানুষও আছে এর মধ্যে। হয়তো ভালো কিছুই হবে। এখন তো গান শুনে সবাই তাজ্জব হয়ে গেছে!’—কোক স্টুডিওতে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে এই কথাগুলো বলছিলেন গীতিকার ফজলু মাঝি। তখন তিনি ফসলের মাঠ থেকে বাড়ি ফিরছেন। আর মোবাইলফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছেন। কেন প্রথমে ঢাকা আসতে বারণ করছিলেন তারা? এমন প্রশ্নে মাঝির ভাষ্য, ‘গ্রামের সবাই আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসে। নৌকা গানের (সারিগান) জন্যই এই ভালোবাসা। এখন তারা ধান কাটতে কাটতেও গানটা গাইছেন।’ জানা যায়, ফজলু মাঝির বাস সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুরের বনগ্রামে। পারিবারিকভাবেই তার গানে হাতেখড়ি। বাবা মো. গুলজার হোসেনও গান গাইতেন, নৌকার ভাইজাল (গায়ক) ছিলেন। ফজলু মাঝি বলেন, ‘আমার বাবাই আমার ওস্তাদ। একসময় উনি নৌকার ভাইজাল ছিলেন। আমার বড় ভাইও ভাইজাল ছিলেন। আমি যখন গান-বাজনা শেখার জন্য যাই, তখন বড় ভাই অনেক সহযোগিতা করেছেন, বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছেন। আসলে আমার পেছনে তাদের অবদানই সবচেয়ে বড়।’ গান বাঁধা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এগুলো অনেক দিনের সাধনা। ১৯৯৮-৯৯ থেকে শুরু করছি। আপনারা দেখলে বুঝতে পারতেন, আমাদের অঞ্চলের মানুষ দিনরাত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। বর্ষায় মাঠ-ঘাট বিলীন হয়ে যায়। এরপরও তারা নৌকা প্রতিযোগিতায় যে আনন্দ করে।’ আষাঢ় মাসে নদীতে পানি বেড়ে যায়। তখন নৌকাবাইচের আয়োজন হয়, আর সেই আয়োজন ভাটিয়ালি-সারি গানের সুরে মাতিয়ে তোলেন ভাইজালরা। জানা যায়, ‘দেওরা’ গানের সুরটি প্রচলিত। ফজলু মাঝি বলেন, ‘এই সুরটা প্রচলিত। একেক জায়গায় একেক রকমভাবে গাওয়া হয়। ‘দেওরা’ গানের কথাগুলো আমারই লেখা। আমরা যখন কোনো মেলায় যাই, তখন সেইখানকার পরিস্থিতি বুঝে একটা সুর তৈরি করি যেন আনন্দ নিয়ে সবাই গাইতে পারি।’ অনেকে ‘দেওরা’ গানটি অশ্লীল বলে মন্তব্য করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ ভাই, হাত ছাইড়া দেও সোনার দেওরারে—এটা কিন্তু দেবর আর ভাবিকে নিয়ে খারাপ কোনো মন্তব্য নয়। ভাইজালরা যখন টানা এক-দেড় ঘণ্টা বৈঠা টাইন্যা যায়, তখন তাদের হাত কিন্তু লাইগ্যা (অবশ) যায়। এক পর্যায়ে তারা বলে ওঠেন—ছাইড়ে দেও, হাত ব্যথা হয়ে গেছে। এই বিষয়টাই আমি গানে টাইন্যা আনছি।’ কৃষিকাজের ফাঁকে ফাঁকে এরইমধ্যে নতুন কিছু গানও বেঁধেছেন এই গীতিকার। মূলত কোক স্টুডিওতে এত ভালো সাড়া পাওয়ার পর সেই ইচ্ছেটা আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ঘুরে আসার ফরে আমি আরও কিছু কথা আবিষ্কার করছি। কিছু সুর বাঁধছি। সামনে ভাটিয়ালি, সারিগান, আধুনিক—মিক্সড কিছু গান করার পরিকল্পনা করেছি। আবারও ভালো কিছু উপহার আপনাদের দেব।’ কল্পনাও করিনি ‘দেওরা’ গান প্রসঙ্গে সংগীতশিল্পী প্রীতম হাসান বললেন, ‘কোক স্টুডিওর কাজটা অসাধারণ। এখন পর্যন্ত আমার কাছে করা সবচেয়ে আনন্দময় কাজ। সময়টা যে কোন দিক দিয়ে গেছে, টেরই পাইনি।’ গানটি প্রকাশের কয়েকদিনের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন রিলস, টিকটকে ঠোঁট মেলাচ্ছেন তরুণ-তরুণীরা। পৌঁছে গেছে দেশের বাইরেও। বিদেশি অনেকেই গানটির সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে বিভিন্ন কনটেন্ট তৈরি করছেন। সম্প্রতি তানজানিয়ার জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটর দুই ভাই-বোন—কিলি পল ও নিমা পল এ গানে ভাইরাল হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে প্রীতম বলেন, ‘এ গানটি ভিনদেশিরাও যে রিল তৈরি করছে এটা খুবই ভালো লেগেছে। গানটি যে এত দ্রুত চারদিকে, গ্রামে-গঞ্জে, দূর-দূরান্তে পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে এটা কল্পনাও করিনি।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অলিম্পিকে নিষিদ্ধ ছিল যে দেশগুলো

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের শঙ্কা

উদ্বোধনীতে অ্যাথলেটদের চেয়ে বেশি উৎফুল্ল বাংলাদেশের কর্তারা

কুষ্টিয়ায় নাশকতা মামলায় আ.লীগ নেতার ছেলে গ্রেপ্তার

৬ দিন পর বরিশাল-ঢাকা রুটে লঞ্চ চলাচল শুরু

ভেজানো ছোলা খাওয়ার উপকারিতা

হামলা মামলা ও লাঞ্ছনার শিকার লালমনিরহাটের ৬ সাংবাদিক

কলেজছাত্রীকে বিবস্ত্র, লজ্জায় আত্মহত্যা

প্যারিসের আলোয় উদ্ভাসিত অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান

ট্রলার উদ্ধারে গিয়ে ডুবল স্পিডবোট, সৈকতে ভেসে এল ২ মরদেহ

১০

সিলেটে ‘অবৈধ’ নিয়োগে প্রভাষক জালিয়াতিতে অধ্যক্ষ!

১১

সজীব ওয়াজেদ জয়ের ৫৩তম জন্মবার্ষিকী শনিবার

১২

ইতিহাসে এই দিনে কী ঘটেছিল?

১৩

অস্ট্রেলিয়ায় উদ্ভাবিত বিশ্বের প্রথম টাইটানিয়াম হার্ট মানবদেহে প্রতিস্থাপন

১৪

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৫

শক্তিশালী পাসপোর্টে শীর্ষে সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশের অবস্থান কত?

১৬

২৭ জুলাই : নামাজের সময়সূচি

১৭

যে ভুলে মরতে পারে টবের গাছ

১৮

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদে ২৪ বছর ধরে চাকরি, অতঃপর..

১৯

ঝিনাইদহে ২৪ বছর ধরে ক্রিকেট ব্যাট বানাচ্ছেন ৩ ভাই

২০
X