সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০১:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তবে ভরসাটা আমাদের কোথায়

তবে ভরসাটা আমাদের কোথায়
আমাদের যে-চেতনা ইহজাগতিক ও গণতান্ত্রিক, যা আপস করে না, যুদ্ধ করে, তাই আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির বিরুদ্ধে যখন লড়ি তখন ওই চেতনার জোরেই লড়ি। একাত্তরে যখন লড়েছি তখনো ওর জোরেই ছিল পুঁজি। নইলে অস্ত্রশস্ত্র বলতে তো কিছু ছিল না, ছিল না কোনো পূর্ব-প্রস্তুতিও। স্বৈরশাসন সে প্রকৃতিরই হোক, কিংবা হোক মানুষের স্বৈরশাসন মানবতাবিরোধী, মানুষ তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে পায়ে পায়ে এগিয়েছে। নিজের মুক্তি নিজেই অর্জন করে নিয়েছে। এই যুদ্ধে চেতনাই তার সর্বোৎকৃষ্ট হাতিয়ার, যে জন্য ওই চেতনাকে বিনষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। সেটা স্বাভাবিক, যেমন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে পরাভব না-মানা। বলা হয়েছে যে, সংস্কৃতি কমিশন যে শুধু সংস্কৃতির ‘স্বরূপ উদ্ঘাটন’ করে ক্ষান্ত হবে তাই নয়, ‘সংস্কৃতি প্রকাশের মাধ্যমগুলোর সংস্কৃতিগত নীতি’ও নির্ধারণ করে দেবে। মাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে মানুষের প্রধান অভিযোগই হলো এই যে, তারা মোটেই স্বাধীন নয়। রেডিও টেলিভিশন তো নয়ই, সংবাদপত্রও স্বাধীন নয়। মনে হয় বেচারাদের ন্যুব্জ কাঁধের ওপর আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ চাপানো হবে। রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছিল, এবার পরিপূরক সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ আসছে। তাতে অবশ্য এটাও বোঝা যায় যে, সংস্কৃতির ব্যাপারটা কত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। সংস্কৃতি কেবল দর্পণই নয়, সংস্কৃতি হাতিয়ারও। হাতিয়ার হারিয়ে গেলে জয় অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কিন্তু জয়ী তো আমাদের হতেই হবে, নইলে আমরা বাঁচব কী করে? করুণা ভিক্ষা করে বাঁচা তো কোনো বাঁচা নয়। মানুষের মতো বাঁচা চাই। যতই আড়ম্বর করুন, সত্য থাকবে এই যে, জনগণের একেবারে আক্ষরিক সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি। অন্ন, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, শিক্ষা—কোনোটাই নেই, আশ্রয়ও নেই। যুগের পর যুগ গেল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম, জনগণ সেখানেই রইল যেখানে ছিল। অগ্রগতি দেখি না, কেবল কিছু লোকের জৌলুস দেখি, যা আগেও দেখেছি। বন্যাকে অনেকে বলেন প্রকৃতির প্রতিশোধ। ঠিকই বলেন, প্রকৃতি মানুষের মিত্র বটে, শত্রুও বটে। পারলেই আঘাত করে। বিশেষ করে তখন, মানুষ যখন প্রকৃতিকে অবজ্ঞা করে। আমরা করেছি। প্রকৃতির সম্পদকে কাজে লাগাতে পারিনি। বন কেটে উজাড় করেছি। নদীগুলোকে ভরে ফেলেছি। নির্মাণের অজুহাতে যেখানে-সেখানে পানিকে আটকে ফেলেছি। কথা ছিল পানি আসবে এবং দ্রুত নেমে যাবে। তা ঘটছে না। প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছে। নানা নামে, নানা ভাবে। প্রকৃতির ক্ষতিসাধন সারা বিশ্বেই চলেছে। যে জন্য ওজোনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি আঘাত করছে পৃথিবীকে। ফলে একদিকে খরা আরেক দিকে বরফ-গলা প্লাবন এবং সমুদ্রের ফুলে ওঠা। এই কোনোটাই সুখবর নয় পৃথিবীর জন্য। আমাদের জন্য খবর ভয়াবহ। ছোট্ট একটু ভূখণ্ডে আমরা ষোলো কোটি মানুষ ঠাসাঠাসি করে বসবাস করি, একের নিঃশ্বাস অন্যের ঘাড়ে লাগে, প্রকৃতির যে কোনো নড়চড় মারাত্মক হতে বাধ্য আমাদের জন্য। যাকে আমরা পুঁজিবাদ বলি প্রকৃতির সে জাতশত্রু। পুঁজিবাদ অন্য কিছু বোঝে না, শুধু মুনাফা বোঝে এবং তারই খোঁজে কখনো কাঠুরিয়া, কখনো দৈত্য হয়ে বার হয় প্রকৃতি-নিধনে। সৌন্দর্য বোঝে না, উপযোগিতাও বুঝতে চায় না, শুধু মুনাফা চায়। এই যে খড়গহস্ত নৃশংসতা—এর বিরুদ্ধে কবিরা বলে গেছেন, বিশেষ করে ইংরেজ রোমান্টিক কবিরা। কেউ শোনেনি। গরিব ও কবির দশা একই—তাদের কথা বাসি হলে ফলে। প্রকৃতি কি এ কথাও বলে না, তোমরা মিলেমিশে থাকো? রোদ, বৃষ্টি কিংবা জ্যোৎস্না যখন আকাশ থেকে নামে, তখন সে তো সবারই সম্পত্তি। সকলেই নাও। প্রকৃতির নীতি বুঝি সেটাই। স্বাভাবিক। সহজ। সরল। কিন্তু মানুষ সেই নীতিকে পদে পদে লঙ্ঘন করে, দেয়াল তোলে, আল খাড়া করে, একে অপরকে সন্ত্রস্ত রাখে। প্রকৃতি কি শোধ নিল তারও? না, আমরা জানি না। অনেক কিছুই জানি না। জানা গেল যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণ সম্পর্কেও বিশেষ কিছু জানা নেই। বিশেষজ্ঞরা জানেন, তবে বিশেষভাবে জানেন না। জ্ঞান খুব গভীর নয়। পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি। এর তাৎপর্য কী? দেশে কি গবেষকের অভাব? না, তা তো নয়। গবেষক আছেন, গবেষণাও রয়েছে। উচ্চতর ডিগ্রি পাচ্ছেন অনেকে। বইপত্র যে প্রকাশিত হচ্ছে না, তা নয়। বিদেশ ভ্রমণ প্রভূত পরিমাণে ঘটছে। সম্মানও পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের মূল সমস্যা যেগুলো, তাদের সম্বন্ধে গবেষণার অভাব। অর্থাৎ কাজের গবেষণা নয়। কাজে যে লাগে না তা নয়, ব্যক্তিগত লাভ নিশ্চয়ই হয়, কিন্তু সমষ্টিগত সমৃদ্ধিতে এসবের কোনো অবদান নেই। কৃষি কিংবা শিল্প, বন্যা কি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বস্ত্র, স্বাস্থ্য, বাসস্থান বা শিক্ষা কোনো ক্ষেত্রেই বিশেষজ্ঞদের গবেষণা বিশেষ কোনো কাজে লাগে না। মেধা যে নেই তাও নয়। বাঙালি মেধাহীন নয়। কিন্তু ওই যে ওই ব্যাপার, ওটা রয়ে গেছে। প্রয়োগ নেই। কাজে লাগে না। জাতীয় মেধা কোন দিকে যাবে? সৃষ্টিশীলতায়Ñনাকি সে আমলা হবে, অথবা ব্যবস্থাপক? এ সিদ্ধান্ত জাতীয়ভাবে নেওয়া হয়নি। হয়নি বা বলছি কেন, অলিখিত সিদ্ধান্ত তো রয়েছে। যেদিকে পয়সা সেদিকেই যাবে। যাচ্ছেও। তবু গবেষণা উঠে যায়নি, হচ্ছে। কিন্তু সেও পয়সার গবেষণা। আমাদের বিদেশি মুরব্বিরা চান মেধাবানরা ব্যস্ত ও সন্তুষ্ট থাকুন, নইলে কে জানে হয়তো বা কমিউনিস্টই হয়ে যাবেন। সে জন্য প্রজেষ্ট দেন, কনসালট্যান্সির ব্যবস্থা করেন। অনেক ক্ষেত্রেই গবেষণার অর্থ দাঁড়ায় তথ্য পাচার। জাতীয় মেধা ও জাতীয় ভাষা একত্রে যাচ্ছে না বলে আমরা আক্ষেপ করে থাকি, বলি মূল্যবান লেখাগুলো বাংলা ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে না, ফলে দেশবাসী উপকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আসল সমস্যা আরও গভীরে। সে হচ্ছে জাতীয় মেধার সঙ্গে জাতীয় প্রয়োজনের বিচ্ছিন্নতা। চুক্তিপত্র যাই লেখা থাকুক, বেশিরভাগই সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার এবং তার আদর্শের (অর্থাৎ পুঁজিবাদের) প্রচারক। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। আমাদের প্রাথমিক সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এগিয়ে এসে ঘাড় চেপে ধরেছে। এই যে শীতের মৌসুম, যখন তখন করার মতো কাজ রয়েছে। আর কিছু না হোক, নদীকে গভীর করা যায়। বলা হয়েছে, যেখানে ড্রেজার লাগবে সেখানে ড্রেজার লাগাতে হবে, কিন্তু অনেক জায়গায় মানুষই পারে, মাটি কেটে নদীর দুধার উঁচু করতে। তা পারবে। কিন্তু নেতৃত্ব দেবে কে? কে করবে উদ্বুদ্ধ? কে ডাকলে সাড়া দেবে মানুষ? সমস্যাটা ওইখানেই। সরকার যে এ কাজ পারবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া তাদের আগ্রহও নেই। থাকার কথাও নয়। এসব কাজে মুনাফা অল্প ঝুঁকি বেশি। প্রবল উদ্দীপনা ও প্রাণবন্যা যদি সৃষ্টি হয় দেশবাসীর মধ্যে, তবে কে বলতে পারে নিশ্চিত করে যে বিপদ বাধবে না? ওই বন্যায় যদি সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়? পাটাতন বিপন্ন হয়ে পড়ে? খাল কেটে কুমির আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বড় বড় বিরোধী দলও যে পারবে না এ কাজ করতে, তা বিলক্ষণ জানা আছে দেশবাসীর। তারাও ক্ষমতায় ছিল, কিন্তু এসব দিকে নজর দেয়নি। তারা চায় সরকার বদল হোক। হ্যাঁ, জনগণও তা-ই চায়। তবে ভিন্ন আশায়। জনগণের প্রত্যাশা সরকার বদল নয়, অবস্থার বদল। তারা চায় তাদের মৌলিক ও প্রাথমিক সমস্যাগুলোর সমাধান, যার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতি বড় বড় বিরোধী দলও দিতে পারছে না। সমাজের মৌলিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল আছে বৈকি। কিন্তু তারা বড় নয়, শক্তিশালী নয়। জনগণের বাঁচার দাবিকে সামনে নিয়ে আসার দায়িত্ব এদের পক্ষেই পালন করা সম্ভব। অস্পষ্টভাবে হলেও জনগণ তা-ই মনে করে। জনগণের দাবিকে যারা পতাকার মতো উঁচুতে তুলে ধরতে পারবে, জনগণ তাদের সঙ্গেই যাবে, যতদূর তারা যায় ততদূরই। এক বন্ধু বলেছিলেন, আগামী পঁচিশ বছরের মধ্যে এ দেশে বসবাস করা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে পড়বে। আমার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ দেখে আশ্বাস দিয়ে বললেন, যা ভাবছ তা নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংস হবে না, ডুববে অপরাধে। তার কথা মিথ্যে হোক এটা সবাই চাইব, তিনি নিজেও চাইবেন, তবে অপরাধ যে বাড়ছে এবং বাড়তে থাকবে সে-বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ তো নেই এবং দেখছিও না। তবে ভরসাটা আমাদের কোথায়? লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অস্ত্রসহ ইউপিডিএফের কর্মী জীবন গ্রেপ্তার 

টেকনাফে ‘জিম্মিঘর’ থেকে ১৪ অপহৃত উদ্ধার

আ.লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা বাংলাদেশের স্বার্থে অপরিহার্য : মামুনুল হক

কুমিল্লায় ট্রেন থেকে পড়ে প্রাণ গেল যুবকের

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতের সংক্ষিপ্ত টাইমলাইন

আট বউ নিয়ে প্রকাশ্যে মোশাররফ করিম

বিশ্বকে প্রথম ‘ড্রোন যুদ্ধ’ দেখাল ভারত-পাকিস্তান

টাইগারদের বোলিং কোচ অ্যাডামসের বিদায়, নতুন কোচ হচ্ছেন টেইট

আ.লীগের নিবন্ধন দ্রুত বাতিল করতে হবে, ইসিকে নাহিদ

দেশেজুড়ে কবে হতে পারে বৃষ্টি জানাল আবহাওয়া অফিস

১০

বিকেলে জুলাই ঐক্য’র জরুরি বৈঠক, আসতে পারে নতুন সিদ্ধান্ত

১১

রাজনৈতিক দলের বিচারে ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধন, গেজেট প্রকাশ

১২

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন জুলাই যোদ্ধা দুর্জয়

১৩

চাঁদা না পেয়ে শিক্ষকের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা

১৪

মেসির গোলের পরও মায়ামির বড় পরাজয়

১৫

নিষিদ্ধ সংগঠনের কোনো কার্যক্রম ঢাকায় চলবে না : ডিআইজি রেজা 

১৬

ছোট ভাইয়ের বাসায় ৪ ঘণ্টা কাটালেন খালেদা জিয়া

১৭

পিনাকী-ইলিয়াস-কনকের ইউটিউব চ্যানেল ব্লক করল ভারত

১৮

আমরা কোনো প্রতিকূল আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আশা করি না : প্রেস সচিব

১৯

সীমান্তে পুশ ইন ঠেকাতে সতর্ক বিজিবি, নিরাপত্তা জোরদার

২০
X