মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
প্রকাশ : ২৪ মে ২০২৩, ০৯:২৩ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বনাম বাংলাদেশ প্রেক্ষিত

বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বনাম বাংলাদেশ প্রেক্ষিত
বিগত প্রায় এক বছর ধরে সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতি একটি নৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুলনামূলকভাবে কোথাও কম, কোথাও বেশি। উচ্চমূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমলেও তিনটি ব্যাংক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, সোজা কথায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে এসব ব্যাংক ততটা বড় ছিল না। অন্য বৃহৎ ব্যাংক এদের কিনে নিয়েছে। সে দেশের উৎপাদন ও কর্মসংস্থানে নিম্নগতি এবং ভোগ চাহিদায় টান পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৯-১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি পর্যায়ক্রমে ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন—যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে প্রভৃতি দেশেও মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপর থেকে বর্তমানে ৫-৭ শতাংশে নেমে এসেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিলে জার্মানির মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ, ডেনমার্কের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ফ্রান্সে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ, ইতালিতে ৮ দশমিক ১ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ভোক্তামূল্য সূচক অনুযায়ী হার ১০ দশমিক ১ শতাংশ, তবে বার্ষিক হার ৫.৭ শতাংশ, নেদারল্যান্ডসের মূল্যস্ফীতি হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, স্পেনে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, নরওয়ের মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। বর্তমানে এশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূল্যস্ফীতি তুরস্কে—৪৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, হাঙ্গেরিতে ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ, লাটভিয়ায় ২০ দশমিক ১ শতাংশ, চেক প্রজাতন্ত্রে ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ভারতের গত মাসের মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ, পাকিস্তানের কোর মূল্যস্ফীতির হার ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। সারা বিশ্বে মূল্যস্ফীতিতে আর্জেন্টিনা সম্ভবত সর্বোচ্চ, এপ্রিলে ১০৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভালো অবস্থানে রয়েছে (৩-৪ শতাংশ)। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি গত বছর আগস্টে সাড়ে ৯ শতাংশে উঠেছিল যা ছিল গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ। তারপর থেকে ৮-৯ শতাংশে ওঠানামা করেছে। এ বছর এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি আবার বেড়ে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে বেসরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী, খাদ্যমূল্যস্ফীতি ২০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। জ্বালানি মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। এবারের মূল্য বৃদ্ধির আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, শহরের চেয়ে গ্রামের মূল্যস্ফীতি বেশি। এর প্রধান কারণ শহরে দ্রব্যাদির সরবরাহ ও চাহিদা উভয়ই বেশি। শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান বাদে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি এখন সর্বোচ্চ। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাস, সার, খাদ্যশস্য, ভোজ্যতেল প্রভৃতির যে দাম, সে তুলনায় আমাদের দেশের বাজারমূল্য অনেক বেশি। গত সপ্তাহের বাজারদর অনুযায়ী মোটা চাল প্রতিকেজি ৪৬-৫০, সরু চাল কেজিপ্রতি ৬৫-৭০, ডিমের হালি ১২০-১৪০, প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয় ২২০-২২৫, গরুর গোশত কেজি ৭৫০-৮০০, বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতিকেজি ১৯৯, চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি ১৩০-১৪০ টাকায়। অথচ চিনি আমদানিতে শুল্ক মওকুফ ছিল। আদা, পেঁয়াজ, রসুনের দাম আবার নতুন করে বেড়েছে। পেঁয়াজ প্রতিকেজি খুচরা মূল্য ৮০ টাকা। যে কোনো ধরনের সবজি গড়ে প্রতিকেজি ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়। গুঁড়োদুধের দাম বেড়েছে লাফিয়ে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্য এবং উৎপাদনের উপকরণের দামও বেড়েছে। ফলে উৎপাদিত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, টয়লেট্রিজ, ওষুধসামগ্রী প্রভৃতির দাম বেড়েছে। সেবা খাতে প্রতিটি আইটেম যেমন—বিমান ভাড়া, বাস ভাড়া, হাসপাতাল ও ডাক্তারের খরচ, হোটেল ভাড়া ইত্যাদিও বেড়েছে। বাজারে লাগামহীন দ্রব্যমূল্যের কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সংকট বেশি। বিভিন্ন খাতে তারা ব্যয় সংকোচন শুরু করেছে। এমনকি সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, দেশে কোনো খাদ্য সরবরাহ চেইনে সংকট নেই, বিশ্ববাজারে দ্রব্যমূল্য কমতির দিকে, দেশে কৃষি উৎপাদন ভালো হয়েছে, সম্প্রতি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়নি। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, দরিদ্রের সহায়তা ও কষ্ট লাঘব এবং শিল্পকারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সরকারি প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে গরিব মানুষের মধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি ইত্যাদি ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করা হচ্ছে। সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানো এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও কৃষিতে ভর্তুকি অব্যাহত রয়েছে। তবু কেন বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতি শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে হচ্ছে না, এর পেছনে রয়েছে কিছু অসৎ ব্যবসায়ীর কারসাজি এবং অতি মুনাফাখোরি প্রবণতা। চাল, ডাল, তেল, চিনি প্রভৃতির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে গুটিকতক ব্যবসায়ী। উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের মধ্যে অনেকটা কার্টেল করে মূল্য নির্ধারণ করে। বাজারের এ সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে কিংবা কঠোরভাবে মনিটর না করা হলে দেশের দ্রব্যমূল্য কমবে না। সে জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলকে দক্ষ ও কৌশলী হতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, অসৎ ব্যবসায়ীরা যেন রাজনৈতিক কিংবা প্রশাসনিক আশ্রয়-প্রশ্রয় না পায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, টিসিবি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ, প্রতিযোগিতা কমিশন প্রভৃতি সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবজি, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, প্রভৃতি কৃষিজ দ্রব্যে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমানোর প্রচেষ্টা নিয়ে কৃষকদের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। সড়কের চাঁদাবাজি, পাইকারি ও খুচরা বাজারের বিভিন্ন সংগঠন ও একশ্রেণির আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের চাঁদাবাজি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান অব্যাহত অগ্রগতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, বাণিজ্য বৃদ্ধি, উৎপাদন বৃদ্ধি, ভোগ চাহিদা, সরকারি ব্যয় প্রভৃতি বৃদ্ধির মাধ্যমে এ দেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত হয়েছে। আমাদের অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি তথা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ উন্নয়নের ফল ভোগ করতে পারছে না। অনেকের কাছে এ উন্নয়ন অর্থহীন হয়ে পড়ছে। সে জন্য সরকার, ব্যবসায়ী, সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদ সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় মূল্যস্ফীতির প্রকোপ কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। লেখক : জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

অস্ট্রেলিয়ায় হামলার আগে মাকে যা বলেছিলেন হামলাকারী

এনসিপির নেতা তামিমের বাবা নিখোঁজ

হাদির ওপর হামলাকারীদের ভারতে পালানো নিয়ে যা বলছে বিজিবি

মহিষ চুরি করে পালানোর সময় গ্রেপ্তার ৩

সঙ্গীর বাবা-মায়ের মন জয় করবেন যেভাবে

সিঙ্গাপুরে হাদির চিকিৎসার খরচ দেবে সরকার : অর্থ উপদেষ্টা

বধূ বেশে সাদিয়া

চবিতে প্রশাসনিক ভবনে তালা

কুষ্টিয়ায় রেলপথ অবরোধ

বিজয় দিবসে যেসব সড়ক এড়িয়ে চলতে বলল ডিএমপি 

১০

সুখ খুঁজছেন অক্ষয় কুমার

১১

ওসমান হাদিকে বহনকারী এয়ার অ্যাম্বুলেন্স সিঙ্গাপুরের পথে

১২

কলকাতায় নিরাপত্তা নিয়ে ‘গুরুতর হুমকি’ অনুভব করেন মেসি

১৩

অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম নীরব ক্ষতি করছে আপনার চোখ ও মস্তিষ্কের

১৪

জীবনহানির শঙ্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী দোলনের জিডি

১৫

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বিএনপি ছিল অগ্রভাগে : সাঈদ আহমেদ

১৬

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে শাহবাগ ব্লকেড

১৭

অস্ট্রেলিয়ায় সমুদ্রসৈকতে গোলাগুলি, অভিযুক্ত বাবা-ছেলে

১৮

এভারকেয়ার থেকে বিমানবন্দরে নেওয়া হচ্ছে ওসমান হাদিকে

১৯

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অপসারণসহ ৫ দাবি ছাত্র অধিকার পরিষদের

২০
X