দেশের অনেক এনজিওর অর্থায়ন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এনজিওগুলোর অর্থায়নের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। আর সনদ নবায়নের সময় রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। এক্ষেত্রে ট্রাস্টসহ সবার লেনদেন হবে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি খাতের ৩৮ সেবা খাতের বিপরীতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক রয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে এই আরও ৬টি খাতকে বাধ্যতামূলক রিটার্নের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরের ৪৪ সেবার বিপরীতে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দেশে কাজ করা এনজিওগুলোর অর্থায়ন কীভাবে হচ্ছে বা কোন খাতে হচ্ছে, তা জানত না সরকার। এসব অর্থায়ন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এবার দেশের সব এনজিও, ট্রাস্ট, সমবায় সমিতি, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। একই সঙ্গে রিটার্নের প্রমাণপত্র দেখিয়ে নবায়ন করতে হবে সনদ। একইভাবে জমি লিজ নিতেও দেখাতে হবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র। এ ছাড়া দলিল লেখক থেকে শুরু করে যারা স্ট্যাম্প বিক্রি করেন তাদেরও বাধ্যতামূলক রিটার্নের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে। এতে জাল স্ট্যাম্প বিক্রির অভিযোগ কিছুটা হলেও কমবে। অভিযোগ রয়েছে, দলিল লেখকরা মোটা অঙ্কের আয় করলেও তারা রিটার্ন দেন না। আর রিটার্ন দিলেও তাদের আয় গোপনের অভিযোগ বেশ পুরোনো। আগামী বাজেটে এই খাতের সঙ্গে সম্পৃক্তদের রিটার্নের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এদের ভেন্ডরদের সনদ নবায়ন করতে লাঘবে রিটার্নের প্রমাণপত্র।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এসব সেবার বিপরীতে রিটার্ন জমা দিত অনেকে। নতুন করে এসব সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আরও করা হচ্ছে। ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স করা ভালো উদ্যোগ। তবে এই পদক্ষেপের ফলে রাজস্ব কতটা বাড়বে এটা দেখতে হবে। আর এই বাধ্যবাধকতার কারণে কেউ কোনো সুযোগ নেয় কি না তাও সরকারকে দেখতে হবে। দেখা গেল আইনি বাধ্যকতার সুযোগ নিয়ে যাতে করদাতাদের কেউ হয়রানি না করে বা মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে কোনো সুযোগ না নেয়, তা নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান এই অর্থনীতিবিদ।
সূত্র আরও জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি জমি লিজ নিতে গেলেও রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। রিটার্নের প্রমাণপত্র না দেখালে হবে না লিজ বা হস্তান্তর। এক্ষেত্রে ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রেও লাগবে রিটার্নের প্রমাণপত্র। এ ছাড়া পৌরসভার ভেতরে ১০ লাখ টাকার বেশি দামের জমি হস্তান্তর করতে গেলেও লাগবে রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র। আর সরকারি-বেসরকারি সরবরাহকারীকে আগামী বাজেটে বাধ্যতামূলক রিটার্নের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি পণ্য সরবরাহ করলে তার রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, এতে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে। মূলত ট্যাক্স কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করতেই এসব প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক রিটার্নের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে বলেও জানান এনবিআর কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালবেলাকে বলেন, এনজিও থেকে শুরু করে ট্রাস্ট এবং ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়ন নিয়ে নানা সময়ে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আসছে। আসলে এসব টাকা কীভাবে আসছে এবং কোথায় বিনিয়োগ হচ্ছে তার সঠিক কোনো তথ্য সরকারের কাছে নেই। এবার এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব খুলে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এতে প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থায়নের সব তথ্য জানতে পারবে সরকার। মূলত এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে কমপ্লায়েন্সের আওতায় নিয়ে আসতে আগামী বাজেটে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে বাধ্যতামূলক রিটার্নের আওতায় রয়েছে, ৫ লাখ টাকার বেশি ব্যাংক ঋণ নিতে চাইলে; কোম্পানি পরিচালক পদ পেতে; আমদানি-রপ্তানি সনদ; ব্যবসা শুরুর ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ ও নবায়নকালে; সমবায় সমিতির লাইসেন্স নিতে; বীমা কোম্পানির সার্ভেয়ার হিসাবে নিবন্ধন পেতে; ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের জমি-ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রিকালে; ক্রেডিট কার্ড নিতে; পেশাজীবী সংগঠনের (চিকিৎসক, দন্ত্য চিকিৎসক, আইনজীবী, হিসাববিদ, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ইঞ্জিনিয়ার, স্থপতি, সার্ভেয়ার) সদস্যপদ পেতে; কাজী সনদ গ্রহণ করতে; বাণিজ্য সংগঠনের সদস্য পেতে; ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র ও বিএসটিআইর সনদ পেতে; বাণিজ্যিক ও শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাস সংযোগ অথবা সিটি করপোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ পেতে; নৌযানের সার্ভে সনদ নিতে; ইটভাটা চালু করতে; বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে; কোম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ পেতে; আগ্নেয়াস্ত্র সনদ পেতে; আমদানির এলসি খুলতে; ৫ লাখ টাকার বেশি ডাকঘর সঞ্চয়পত্র ও ৫ লাখ টাকার বেশি অন্য সঞ্চয়পত্র কিনতে; ব্যাংক হিসাব খুলতে; উপজেলা, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে; যৌথ মালিকানাধীন ব্যবসায়িক অংশীদার হলে; বীমা কোম্পানির এজেন্সি সনদ নবায়ন করতে; মোটরসাইকেল ও সিএনজি ছাড়া অন্য যানবাহনের মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নকালে; বিদেশি অনুদান গ্রহণকারী এনজিও বা ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সনদ গ্রহণ করতে; আমদানি-রপ্তানি পণ্যের বিল অব এন্ট্রি জমা দিতে; অভিজাত ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ করতে; বাড়ির নকশা অনুমোদন করতে চাইলে, সরকারি-বেসরকারি দরপত্র জমা দিতে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা গ্রহণকালে, ১৬ হাজার টাকার বেশি মূল বেতনভোগী সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন তুলতেও রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে।