এডিএইচডি হলো শিশুদের অতিমাত্রায় চঞ্চলতা, অতি আবেগ এবং অমনোযোগিতা। রোগটি ১২ বছরের কম বয়সের শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে ১-৪ বছর বয়সীদের মাঝে বেশি দেখা যায়।
অতিমাত্রায় চঞ্চলতা এডিএইচডি শিশুর প্রথম উপসর্গ। এটি শিশুদের স্নায়ু বিকাশজনিত আচরণগত সমস্যা। সাধারণত ছেলে শিশুদের মাঝে মেয়েদের তুলনায় এটি ৩ গুণ বেশি দেখা যায়।
নির্দিষ্ট কোনো কারণ এর জন্য দায়ী নয়। তবে দেখা গেছে, যমজ শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রবণতা বেশি। মা-বাবার মধ্যে থাকলে এ রোগ শিশুর মাঝে আসার আশঙ্কা বেশি। এ ছাড়া মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন, স্নায়বিক রাসায়নিক পদার্থের তারতম্য, হরমোন, মস্তিষ্কের প্রদাহ, পরিবেশগত কারণসহ নানা কারণে এ রোগ দেখা দেয়।
জিনগত কারণের মধ্যে শরীরে ডোপামিন রিসেপটরে জেনেটিক মিউটেশনকেই বিজ্ঞানীরা মূলত এ রোগটির জন্য দায়ী বলে মনে করছেন। মস্তিষ্কের গঠনগত পরিবর্তন যেমন—মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের (Basal ganglia & Frontal lobe) আকৃতি ছোট হওয়া ইত্যাদি।
মস্তিষ্কের প্রদাহ বলতে বাচ্চা গর্ভে থাকা অবস্থায় রুবেলা ভাইরাস, সাইটোমেগালো ভাইরাস, হারপিস সিম্পেক্স ভাইরাস, এইচআইভি ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হলে হতে পারে। পরে নবজাতকের মস্তিষ্কে জীবাণু সংক্রমণের কারণেও (যেমন মেনিনজাইটিস এবং এনসেফলাইটিস) এরকম হতে পারে।
কখনো এসব শিশুর রক্তে সিসার আধিক্য অথবা হরমোনের তারতম্য দেখা যায়। ফাস্টফুড, ফুড এডিটিভস, খাদ্য রঙিন করার রং খাদ্যকে অধিক দিন সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত দ্রব্যাদিও এ রোগের প্রখরতাকে বাড়িয়ে দেয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
এডিএইচডি রোগের উপসর্গ হলো—
১। এডিএইচডি শিশুরা অতিমাত্রায় অমনোযোগী এবং অতিচঞ্চল হয়ে থাকে।
২। এ শিশুরা এক জায়গায় স্থির থাকে না।
৩। স্কুলে শিক্ষকদের কথায় মনোযোগ না দিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে।
৪। স্কুলের প্রয়োজনীয় জিনিস যেমন—খাতা-কলম হারিয়ে ফেলে।
৫। রেজাল্ট খারাপ হতে পারে।
৬। কোনো কাজ শেষ না করে অন্য কাজ ধরা।
৭। কখনো ক্ষিপ্ত ও আক্রমণাত্মক হতে পারে।
৮। বেশি কথা বলবে এবং প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবে।
৯। নিজের ইচ্ছামতো চলতে পছন্দ করবে।
১০। পরিণতি না বুঝে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে বসে।
চিকিৎসা: চিকিৎসা ব্যবস্থা নির্ভর করে শিশুর বয়স, রোগের উপসর্গ ও রোগের মাত্রার ওপর। এ জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রতিটি শিশুর জন্য ভিন্ন ভিন্ন।
বাজারে অনেক ধরনের ওষুধ রয়েছে। মিথাইল ফেনিডেট, রিসপেরিডন, ডেক্সএমফিটামিন, এটোমক্সেটিন, ইমিপ্রামিন জাতীয় ওষুধ এ রোগের উপসর্গকে কমাতে সাহায্য করে। এসব ওষুধে সাধারণত ৭৫-৯০% ভাগ শিশুর উপসর্গ দূর হয়। তবে এসব ওষুধ অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সেবন করতে হবে।
খাবারের সীমাবদ্ধতা: ধারণা করা হয়, কোনো কোনো খাবার এ রোগের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই এডিএইচডি শিশুদের ক্ষেত্রে ফাস্টফুড, চকলেট, সস, মেগা ভিটামিন, ফুড এজিটিভস, খাবারে প্রিজারভেটিভ, রঙিন খাবার ইত্যাদি পরিহার করা খুবই জরুরি।
ব্যবহারিক শিক্ষা: ওষুধের পাশাপাশি কিছু কিছু ব্যবহারিক শিক্ষা যেমন—নিউরো বিহ্যাবিয়ার থিরাপি, সেন্সরি থেরাপি ইত্যাদি) রোগের মাত্রা কমানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এডিএইচডি শিশুর মা-বাবার জন্য পরামর্শ :
শিক্ষকদের সঙ্গে শিশুর সমস্যাটি শেয়ার করা।
শিশুর প্রতিদিনের রুটিন তৈরি করা এবং সেই অনুযায়ী তাকে দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত রাখা।
শিশুকে শান্ত রাখার ব্যবস্থা করা।
শিশুকে সহজ-সরল ভাষায় উপদেশ দেওয়া এবং ভালো আচরণ করা।
একই সঙ্গে অনেক কাজ না দিয়ে ছোট ছোট নির্দেশনামূলক কাজ করানো।
অন্য শিশুদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সুযোগ দেওয়া।
শিশুকে সৃজনশীল কাজে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেওয়া।
বাসার ছোট ছোট কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া।
ভালো কাজের প্রশংসা করা।
মন্দ কাজের জন্য বেশি কঠিন না হয়ে বোঝাতে চেষ্টা করা।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই লক্ষণগুলো অনেকাংশে কমলেও কিছু সমস্যা থাকতে পারে। তবে ছোট বয়সে শিশুর মধ্যে এ রোগের উপসর্গ দেখা দিলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে। তাই প্রাথমিক অবস্থায় উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হয় বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
লেখক : চেয়ারম্যান, শিশু নিউরোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ, ঢাকা