রাজকুমার নন্দী
১৭ মে ২০২৩, ১১:২০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ নতুনভাবে করবে বিএনপি

সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন শুরুর প্রায় পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে এখনো একটি ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ প্রণয়ন করতে পারেনি বিএনপি ও মিত্ররা। গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ মিলে যৌথ ঘোষণার ৭ দফা একটি খসড়া রূপরেখা প্রণয়ন করলেও যুগপতের অন্য শরিকদের আপত্তিতে তা চূড়ান্ত করা যায়নি। কারণ, এ ইস্যুতে গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়া বাকি শরিকরা তখন কার্যত অন্ধকারে ছিল। পরে আন্দোলনে থাকা সব দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এর অংশ হিসেবে গণতন্ত্র মঞ্চ সম্প্রতি ৩৫ দফার একটি খসড়া রূপরেখা বিএনপির কাছে হস্তান্তর করে, যা বিএনপির ২৭ দফাকে ভিত্তি ধরে প্রণয়ন করা। কিন্তু প্রস্তাবিত সেই খসড়ায় ‘নির্বাচনকালীন সরকারের কার্যক্রম’ নিয়ে আপত্তি দেখা দেয় প্রধান শরিক বিএনপিতে। তাই, এখন নতুনভাবে আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।

নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বিগত দুটি বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের ৩৫ দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে নজরুল ইসলাম খানসহ স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্যের সমন্বয়ে একটি ড্রাফট কমিটিও গঠন করা হয়েছে। ৩৫ দফাকে সামনে রেখে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার ভিত্তিতে ড্রাফট কমিটি শিগগিরই যৌথ ঘোষণাপত্রের একটি নতুন খসড়া প্রণয়ন করবে। তারপর সেটি নিয়ে যুগপতের সব মিত্রের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে তা চূড়ান্ত করা হবে। আর যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত হওয়ার পরই যুগপতের নতুন কর্মসূচি মাঠে গড়াবে।

বিএনপি ও মিত্ররা এখন যুগপতের ধারায় দলীয় ব্যানারে কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপির দুজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে বিএনপি নতুন করে ‘ঘোষণাপত্র’ প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ায় বিষয়টি ঝুলে গেল বলে মনে করছেন শরিকরা।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান কালবেলাকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। সুনির্দিষ্টভাবে ঘোষণার দিনক্ষণ বলা সম্ভব নয়, তবে যে কোনো সময় এটি ঘোষণা করা হবে।

সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ ১০ দফার ভিত্তিতে গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়। এর দেড় মাস পর গত ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে একটি যৌথ ঘোষণাপত্র প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এ লক্ষ্যে ওই মাসে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের সমন্বয় একটি ড্রাফটস কমিটি গঠন করা হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বিএনপির ১০ দফা দাবি ও রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার সমন্বয়ে যৌথ ঘোষণাপত্রের ৭ দফা একটি খসড়া প্রস্তুত করে। কিন্তু বাকি শরিকদের চাপে পরে ওই ঘোষণাপত্র থেকে সরে যায় বিএনপি। এমনকি তারা বিএনপির ১০ দফা ও ২৭ দফা এবং গণতন্ত্র মঞ্চের ১৪ দফার বাইরে নতুন করে পৃথক দফা প্রণয়নের বিরোধিতাও করেন। তাদের যুক্তি, দেশবাসী এসব দফা এরই মধ্যে গ্রহণ করেছে। নতুন করে আবার দফা দিলে তাতে জনগণ বিভ্রান্ত হতে পারে। তবে ঘোষণাপত্র প্রণয়নের সিদ্ধান্তে অটল থাকে বিএনপি। শরিকদের দাবি, গণতন্ত্র মঞ্চের চাপে বিএনপি যৌথ ঘোষণপত্র প্রণয়নে বাধ্য হচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র মঞ্চ গত ৮ মে ৩৫ দফা যৌথ ঘোষণার একটি খসড়া বিএনপির কাছে হস্তান্তর করে। এরপর এটি নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, আগে চলমান আন্দোলন সফল করা প্রয়োজন। সেটাই তাদের মূল ফোকাস। আর গণতন্ত্র মঞ্চ সরকার গঠনের পরে নানা সংস্কার নিয়ে কথা বলছে। যদিও বিএনপির ২৭ দফাতেই সব সংস্কারের বিষয়গুলো বলা আছে। গণতন্ত্র মঞ্চ তাদের ৩৫ দফা বিস্তৃত করেছে কিছু শব্দগত পার্থক্যের মধ্য দিয়ে। ২৭ দফার মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে তাদের অবস্থান বা দফা সাংঘর্ষিক নয়। তবে ৩৫ দফায় ‘নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ শব্দ ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে বিএনপির আপত্তি আছে। কারণ, বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। ২৭ দফায় নির্বাচনকালীন এ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলাও হয়েছে।

যুগপৎ আন্দোলন শুরুর আগে রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারে গত ১৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখা ঘোষণা করে বিএনপি। দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা এবং চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঘোষিত ‘ভিশন-২০৩০’-এর আলোকে ২৭ দফার ওই রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়। ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী কী করতে চায়, ওই রূপরেখার মধ্যে সেটা স্পষ্ট করেছে বিএনপি। রূপরেখায় তারা সংবিধান সংস্কার কমিশন, জাতীয় সমঝোতা কমিশন, জুডিশিয়াল কমিশন, প্রশাসনিক কমিশন, মিডিয়া কমিশন, অর্থনৈতিক সংস্কার কমিশন করবে বলে ঘোষণা করেছে। সেখানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনয়নের কথাও বলা হয়েছে।

২৭ দফায় আরও বলা হয়েছে, চলমান আন্দোলনে বিজয় অর্জনের পর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয়ী হলে আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে, যে সরকার রাষ্ট্রের সার্বিক সংস্কারে কাজ করবে, যা পরবর্তী সময়ে দলটির পক্ষ থেকেও ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, গণতন্ত্র মঞ্চ তাদের প্রস্তাবিত ৩৫ দফায় বলেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের বাঁচার জরুরি সংকটের সমাধান, রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি করবে। বিএনপি মনে করে, এটা নির্বাচনকালীন সরকারের দায়িত্ব নয়। এটা করতে কয়েক বছর সময় লাগবে, যা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার করতে পারে। এ নিয়ে বিএনপিতে আপত্তি রয়েছে। তাই দলটি এখন নতুনভাবে আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করবে। গণতন্ত্র মঞ্চের ৩৫ দফাকে সামনে রেখে বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফার ভিত্তিতে এ ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হবে। এ ক্ষেত্রে গণতন্ত্র মঞ্চের ৩৫ দফার মধ্যকার অতিরিক্ত দফা যেগুলো যৌক্তিক সেগুলো উপদফা আকারে ২৭ দফায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

তবে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে এখনো মতপার্থক্য রয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চের ৩৫ দফায় সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাস বিল ব্যতিরেকে সব বিলে সংসদ সদস্যদের স্বাধীন মতামত প্রদানের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ২৭ দফায় বলা হয়েছে, আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন বিষয় ব্যতীত অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এ নিয়ে বার্গেনিং হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মঞ্চের নেতারা বলছেন, বিএনপির অবস্থান হচ্ছে-এ ইস্যুতে ‘নির্বাচন-পরবর্তী জাতীয় সরকার’ এসে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ছাড়া বিএনপি রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য আনয়নের কথা বললেও কার কতটুকু ক্ষমতা থাকবে—গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আলোচনায় সে বিষয়টিও বেশিদূর এগোয়নি।

এদিকে আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে গত সোমবার গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চ যৌথ ঘোষণাপত্র হিসেবে ১০ দফা, ২৭ দফা ও ১৪ দফার বাইরে নতুন দফা চায়। মঞ্চ মনে করে, আন্দোলনের এসব দফা এরই মধ্যে ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। তাই নতুন দফা প্রয়োজন। আন্দোলন সফলে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এ ক্ষেত্রে বিএনপিসহ যুগপতের শরিক সব দল ও জোটকে ছাড় দিতে হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতা বলেন, তারা কেবলমাত্র সরকার বদলের জায়গায় ঘুরপাক খেতে চায় না। সরকার ও শাসন ব্যবস্থা বদলের লক্ষ্যে মিনিমাম যা যা প্রয়োজন সেটা করতে হবে, এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় নয়। তবে বিএনপি অঙ্গীকারের জায়গা থেকে ক্রমেই সরে যাচ্ছে বলে মনে করেন তারা।

যৌথ ঘোষণাপত্র প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘চলমান আন্দোলনে গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য যৌথ ঘোষণাপত্র লাগবে। এটা চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। এ ব্যাপারে সবাই ইতিবাচক, হয়তো কিছুটা সময় লাগছে। আমরা আশাবাদী, অচিরেই যৌথ ঘোষণাপত্র আসবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সর্বোচ্চ করদাতা কণ্ঠশিল্পী তাহসান-রুবেল-মমতাজ

সাগরের তলদেশে পাইপলাইন দিয়ে ডিজেল পরিবহন শুরু

অবরোধ সফলে বরিশালে বিএনপির মশাল মিছিল

থার্টি ফার্স্ট নাইট নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনা

স্ত্রীর চেয়ে স্বর্ণ বেশি জাপার মাসুদ চৌধুরীর

ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন অনন্ত জলিল

সুনামগঞ্জে বিএনপির মশাল মিছিল  

যুদ্ধের মধ্যে নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলার বিচার পুনরায় শুরু

ক্রীড়াঙ্গনে সেরা করদাতার তালিকায় সাকিব তামিম রিয়াদ

ঢাকায় রিজভীর নেতৃত্বে মশাল মিছিল

১০

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মোহাম্মদ জিল্লুর রহমানের সৌজন্য সাক্ষাৎ

১১

সাতক্ষীরায় আচরণবিধি ভঙ্গ হচ্ছে কিনা দেখতে অভিযান

১২

‘তদারকির অভাবে ব্যবসায়ীরা জনগণের গলাকাটার সুযোগ পায়’

১৩

নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন অভিযোগের জবাব দিলেন শিবলী সাদিক

১৪

ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার মতো অর্থ নেই যুক্তরাষ্ট্রের

১৫

এবারও সেরা করদাতা জর্দা ব্যবসায়ী কাউছ মিয়া

১৬

আবারও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গ

১৭

গানের স্বত্ব নিয়ে শাফিন-হামিনের দ্বন্দ্ব

১৮

শাহজাহান ওমরের বাড়ির বিএনপি কার্যালয় এখন আ.লীগের নির্বাচনী অফিস

১৯

সেমিফাইনালে কিংস-মোহামেডান

২০
X