জন্ডিস বলতে সাধারণত আমরা শরীর, বিশেষ করে চোখের সাদা অংশ, জিহ্বার নিচ, হাতের তালু, পায়ের পাতা হলুদ হয়ে যাওয়াকে বুঝি। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে জন্ডিসের মাত্রা ও কারণ বুঝতে গেলে বয়স বিবেচনা খুবই জরুরি। যেমন—জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে অনেক নবজাতকের শরীর হলুদ হয়ে যায়। এর সঙ্গে হেপাটাইটিস ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই। আবার হয়তো কোনো কিশোর বয়সের রোগী বারবার রক্ত নেয় (যেমন থ্যালাসেমিয়া রোগী)। তার রক্তে বাহিত হেপাটাইটিস (বি, সি ভাইরাস) হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। তবে আমাদের সমাজে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্কদেরও সবচেয়ে বেশি যে জন্ডিস দেখা দেয়, সেটি হচ্ছে হেপাটাইটিস ‘এ’ এবং ‘ই’ ভাইরাস দিয়ে হওয়া জন্ডিস। এ দুটি ভাইরাসই দূষিত পানি এবং খাবারের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে।
আক্রান্ত রোগীর মলের মাধ্যমে ভাইরাস পানি কিংবা অন্যান্য খাবারে মিশে যায়। এমনকি নোংরা হাতে তৈরি খাবারেও এটি থাকতে পারে।
লক্ষণ
খাবার বা পানীয়র মাধ্যমে ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে দুই সপ্তাহ থেকে দুই মাসের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ করে। জন্ডিসের ভাইরাস যকৃৎকে আক্রমণ করে তাই অসুখের লক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে যকৃতের সাময়িক কার্যকারিতা কমে যেতে শুরু করে। প্রথম এক-দুই সপ্তাহ শিশু ক্ষুধামন্দা, বমিভাব, বমি, গা ম্যাজম্যাজ হতে পারে। অনেকেরই অল্পমাত্রার জ্বর, পেটে ব্যথা (বিশেষ করে পেটের ডানদিকের ওপরের দিকে) থাকতে পারে। পরের সপ্তাহে অসুস্থ শিশুদের গাঢ় হলুদ প্রস্রাব, সাদাটে পায়খানা আর চুলকানি থাকতে পারে। অনেকেরই আগের লক্ষণগুলো তখন সেরে যাওয়া শুরু হয়। তৃতীয় সপ্তাহ থেকে রোগী আরোগ্যের দিকে যেতে থাকে।
জটিলতা
সাধারণত জন্ডিস এমনিতেই সেরে যায়। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে জন্ডিসের একটি ভয়ংকর জটিলতা নিয়ে। অনেক শিশুরই জন্ডিস থেকে মস্তিষ্কের জটিল অসুস্থতা (হেপাটিক এনকেফালোপ্যাথি) হতে পারে। জন্ডিস আক্রান্ত শিশু অসংলগ্ন ব্যবহার বা কথাবার্তা বলে কিনা খেয়াল করুন। রাতের চেয়ে দিনের ঘুম গাঢ় মনে হলে কিংবা স্কুলপড়ুয়া বাচ্চারা ছোটখাটো পড়ালেখায় বেশি ভুল করতে থাকলে সতর্ক হতে হবে। এমন হলে সঠিক চিকিৎসা খুবই জরুরি। তা না হলে পরে আরও দুর্বলতা, পেটে পানি আসা, রক্তবমি, খিঁচুনি থেকে অজ্ঞান পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এমনকি অকার্যকর যকৃত (ফালমিনেনট হেপাটিক ফেইলার) নিয়ে শিশুর মৃত্যুবরণ করতে পারে।
রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা
জন্ডিসের মাত্রা, যকৃতের কার্যকারিতা এবং সম্ভাব্য জটিলতা দেখতে কিছু রক্ত পরীক্ষা এবং অনেক সময় আলট্রাসনোগ্রাফি করা লাগতে পারে। এ ছাড়া কোন ভাইরাস দিয়ে জন্ডিস হয়েছে এটা বের করাও জরুরি। জটিল ক্ষেত্রে জন্ডিসের চিকিৎসা অবশ্য খুব সীমিত। পর্যাপ্ত বিশ্রামে থাকাই অনেকের একমাত্র চিকিৎসা হতে পারে। শিশুকে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে দেওয়া যাবে না। এরকম অবস্থা প্রতিরোধে ল্যাকটুলোজ জাতীয় সিরাপ দেওয়া হয়। ঘরে তৈরি সহজপাচ্য, পরিষ্কার, টাটকা খাবার খেতে হয়। ফলের রস, দুধ খাওয়া যেতে পারে। যকৃতকে বিশ্রাম দিতে অতিরিক্ত তেল, চর্বি, মাংস পরিহার করতে হবে। অধিকাংশ শিশু এটুকু ব্যবস্থাপনায় সুস্থ হয়ে ওঠে।
রোগ প্রতিরোধ
হেপাটাইটিস ‘এ’ ভাইরাসের প্রতিরোধে জন্য শিশুকে টিকা দেয়া নিরাপদ। এক বছরে ঊর্ধ্বে যে কোনো শিশুকে মাংসপেশিতে এ টিকা দেওয়া যায়। প্রথম টিকার ছয় মাস থেকে এক বছর পর দ্বিতীয় টিকা নিতে হয়। তবে আমাদের জোর দিতে হবে হেপাটাইটিসসহ অন্যান্য পানিবাহিত রোগ প্রতিরোধের দিকে। পাশাপাশি সমাজে প্রচলিত কিছু কুসংস্কার দূর করা জরুরি।
রাস্তার পাশে থাকা আচার, ফুচকা, চটপটি, হোটেলের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি খাবার এসব জীবাণুর বড় উৎস। এসব অনিরাপদ খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।
মলত্যাগের পর, রান্নার আগে হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। সবজি, থালাবাসন ধোয়ার সময় পরিষ্কার, জীবাণুমুক্ত পানি ব্যবহার করতে হবে। ফোটানো বা ফিল্টার করা নিরাপদ পানি পান করতে হবে। আমাদের দেশে রেস্টুরেন্ট, মার্কেটে তথাকথিত ‘ফিল্টার করা পানি’ গ্লাসে পরিবেশন করা হয়, যেগুলো ভাইরাসের বিরুদ্ধে তেমন কার্যকর নয়।
জন্ডিস প্রকাশের সাত দিন পর্যন্ত রোগী মলের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এ সময় শিশু স্কুলে যেতে পারবে না এবং বড় রোগীরা খাবার তৈরির কাজ করবে না। শিশুদের ডায়াপার পরিবর্তন এবং শুচি করার পর অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
ডাবের পানি, আখের রস জন্ডিস কমাতে কোনো সাহায্য করে না। বরং রাস্তার আখের রস ভাইরাসের উৎস হতে পারে। স্বাস্থ্যকর তরল খেতে হবে তবে অতিরিক্ত পরিমানে নয়।
তরকারির হলুদের সঙ্গে শরীর হলুদ হওয়ার সম্পর্ক নেই। তবে এ সময় গুরুপাকের, ভাজাপোড়া খাবার খাওয়া যাবে না।
কবিরাজি চিকিৎসা যেমন—মাথা ধোয়ানো, বনাজি বা ঝারানো শুধু অপচিকিৎসাই নয়, প্রতারণা। ভুল ওষুধ বা চিকিৎসা যকৃতের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।
লেখক : রেজিস্ট্রার, আইসিএমএইচ, মাতুয়াইল, ঢাকা