সুমনকুমার দাশ
প্রকাশ : ১৯ নভেম্বর ২০২২, ০৮:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কবিয়াল বিজয় সরকারের গান ও জীবনদর্শন

কবিয়াল বিজয় সরকারের গান ও জীবনদর্শন
এত আক্ষেপ, এত বিচ্ছেদ, এত যন্ত্রণাদগ্ধ-উচ্চারণ তার গানে—এমনটা পল্লিগানের আর কোনো গীতিকারের সৃষ্টিতে বড় বেশি মেলে না। কিন্তু কেনই-বা বিজয় সরকারের আকণ্ঠ এত বিরহ, এর কারণটাই-বা কী? তবে কি কৈশোরে বাবা আর যৌবনে স্ত্রী-সন্তানকে হারানোই এর মূল কারণ? যেমনটা ঘটেছিল নেত্রকোনার বাউল-গীতিকার উকিল মুনশির [১৮৮৫-১৯৭৮] ক্ষেত্রেও। উকিল আর বিজয় যেন একাকার জীবন ও সৃষ্টিতে। তফাত এতটুকুই, শেষ বয়েসে বিজয় দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন। তবে সেটাও মিলে যায় রুশ লেখক নিকোলাই অস্ত্রভস্কির [১৯০৪-১৯৩৬] জীবনের সঙ্গে। অন্ধত্বাবস্থায় যেমন অস্ত্রভস্কি তার যুগান্তকারী উপন্যাস ‘ইস্পাত’ রচনা করেছেন, তেমনি ভাবে বিজয় সরকারও তার দৃষ্টিহীন অবস্থায় রচনা করেছেন কালোত্তীর্ণ অসংখ্য বেদনামথিতগান। দুই. জীবন আর মৃত্যুকে গভীরভাবে ছেঁকে দেখা বিজয় সরকার আত্মা আর পরমাত্মার চিত্রপট সাজিয়েছেন এভাবে : আমার পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী একদিন ভাবি নাই মনে পোষা পাখি উড়ে যাবে সজনী একদিন ভাবি নাই মনে সে কি আমায় ভুলবে কখনো একদিন ভাবি নাই মনে। বিজয় সরকারের ‘পোষা পাখি’ অর্থাৎ আত্মা তার দেহ ছেড়ে উড়ে যায় ১৯৮৫ সালের ৪ ডিসেম্বর, ভারতের বেলুড়ে। এরও বহু আগে বিজয়ের দেহরূপী ‘সোনালি খাঁচায়’ আত্মা জন্ম নেয় ১৯০৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, বাংলাদেশের নড়াইলের ডুমদিতে। আত্মার জন্ম আর উড়ে যাওয়ার মাঝখানে প্রথম দশ বছর বাদে বিজয়ের পুরো জীবনই কাটে মূলত সংগীত-সাধনায়। বিজয় সরকারের শৈশব কেটেছে যাত্রাদলে বিবেকের ভূমিকায় অভিনয়সহ গান গেয়ে, আরেকটু বড় হলে কবিগানেও দক্ষতা অর্জন করেন তিনি। পরে তো নিজেই কবিগানের দল প্রতিষ্ঠা করেন, ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন নামকরা এক কবিয়াল। নিজে বৈষ্ণব মতাদর্শী হলেও সুফিবাদে তার প্রবলভাবে আকৃষ্ট থাকার প্রমাণও মেলে। জীবনভর নানা পর্যায়ের গান লিখেছেন, গেয়েছেন। কমবেশি চারশ গানের রচয়িতা তিনি। তার রচিত কবিগানের উপধারার মধ্যে আসরবন্দনা, মালসি, সখী-সংবাদ, টপ্পা, পাঁচালি, ভোরগোষ্ঠ, বসন্ত, করুণগোষ্ঠ, মিলনগোষ্ঠ উল্লেখযোগ্য। এর বাইরেও তার রচিত গানগুলোকে ভাটিয়ালি, মরমি, কীর্তন, আধুনিক ও দেশাত্মবোধকসহ নানান পর্যায়ে ফেলা যায়। তবে তার বিচ্ছেদভুক্ত গানগুলো শ্রোতাদের তীব্রভাবে বিহ্বল করে। হাহাকার আর খেদ-ই বিজয় সরকারের অধিকাংশ গানের মূল বিষয়বস্তু। জীবনকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নিরীক্ষা করতে জীবনচক্রকে আতসকাচের নিচে রেখে বুঝতে চেয়েছেন পার্থিব ও অপার্থিব অনুভূতিকে। এই গভীর সত্যের সন্ধানে পথ চলতে গিয়ে যা অনুধাবন করেছেন, সেসবের সারসংক্ষেপ উৎসারিত হয়েছে তার গান রচনায়। জীবনভর বহু জানা-বোঝার মিশেলে তৈরি হওয়া অভিজ্ঞতার কারণেই হয়তো গানে তৈরি করতে পেরেছেন প্রাজ্ঞতার এমন খোদাইচিত্র : ‘অজানা এই সংসারপুরে পথ না চিনে মরলি ঘুরে/ পড়ে রলি অনেক দূরে, এলো সন্ধ্যাকা’ কিংবা ‘এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনই ঠিক রবে/ সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে’। বিজয় সরকার লিখেছেন, ‘অরূপ স্বরূপের রূপে এরূপ যে জন হয়/ তার শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ সকলি তন্ময়’। এক গ্রামীণ কবিয়ালের পক্ষে কীভাবে সম্ভব এমন অনুভূতি অর্জন? আসলে নিঃসীম নীরবতার পথিক না হলে এমন চিত্রকল্প কল্পনায় আনাও মুশকিল। আত্মীয়-পরিজন, স্বজন, বন্ধুবেষ্টিত থেকেও বিজয় ছিলেন একেবারেই নিঃসঙ্গ, বিচ্ছেদাক্রান্ত। ফলে তার চিন্তার জগৎ ফালা-ফালা করে দিয়েছে বিরহবেদনাবোধ। তাই তো দুঃখরা আশ্চর্য এক বিষণ্নতায় তার গানে সব সময়ে ভর করে: তারে আর কি ফিরে পাব রে যারে হারিয়েছি জীবনে [...] নদীর কূল ভরিয়ে ওঠে ভেঙে গেলে পর ভাঙা মনের কূলে ভুলে কভু পড়ে না রে চর [...] জীবনে যা হারিয়েছি পাব না তা আর এইটুকু মাত্র রইল পুঁজি প্রাণের হাহাকার [...] কিংবা তুমি জানো না তুমি জানো না রে প্রিয় তুমি মোর জীবনের সাধনা [...] তুমি চলে গেলে আমায় ফেলে, কী আগুন এই বুকে জ্বেলে একদিনও দেখিতে তুমি এলে না [...] অথবা আমার মনে মেনেছে, আমার জানে জেনেছে, তুমি আসবে না নয়নে ছাড়ে না, তবু পথ চাওয়া ওগো পরাণপ্রিয় তোমার লাগি জীবনযৌবন ধরম করম শরম ভরম সকলই গেছে খোয়া মনে বলে আসবে না সে, নয়নে কয় আসে আসে গো বসে আছি পথের পাশে, হলো না ঘরে যাওয়া। বিজয়ের সরকারের গানগুলো পর্যালোচনা করলেই দেখা যায়, তাকে প্রতিনিয়ত ভেঙেচুরে জর্জরিত করে ফেলেছে দুঃখবোধ, বেদনারা। তার একেকটি গান যেন বিরহের ক্যানভাস। ফলে তার প্রায় গানের শরীর কষ্টের আস্তরণে ঢাকা, বিষাদমাখা। তিন. নিকোলাই অস্ত্রভস্কি কিংবা উকিল মুনশি, তারা জীবনের তিক্ত আর দুঃসহ স্মৃতি অভিজ্ঞতাকে সৃষ্টিতে ঠাঁই দিয়ে কালজয়ী হয়েছেন, তেমনটা বিজয় সরকারও। ফলে তার গানও মানুষকে মন্দ্রিত করে রাখছে। পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীন (১৯০৩-১৯৭৬) সেই কবেই তার ‘জীবনকথা’ (১৯৬৪) বইয়ে লিখেছেন : ‘মাঝে মাঝে দেশীয় গ্রাম্য গায়কদের মুখে বিজয়ের রচিত বিচ্ছেদ গান শুনিয়া পাগল হই। এমন সুন্দর সুর বুঝি কেহই রচনা করিতে পারে না। ছাপাখানা বা রেডিও গ্রামোফোনের সাহায্য ব্যতিরেখে বিজয়ের নতুন সুরের গানগুলো গ্রামবাংলার সর্বস্তরে ছড়াইয়া পড়িতেছে।’ এখনো অনেকটা তাই। বিজয় সরকারের গান ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে, শহরে। দিনে দিনে তিনি কেবল চিরকালীন হয়ে উঠছেন, উজ্জ্বল তো বটেই।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ডেঙ্গু জ্বর: কিছু তথ্য

এইচএসসিতে প্রশ্নপত্র নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সতর্কতা

জুলাই অভ‍্যুত্থান : মাসব্যাপী কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা

৪৪তম বিসিএসের প্রশাসন ক্যাডারে প্রথম ফরহাদ

‘দুঃখিত, এবার আর তা হবে না’

‘কূটনীতির দরজা কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয় না’

তেলের দামে বড় পতনের আভাস

এসএসসি পাসেই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে চাকরি

৩২৯ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ, বাবা-ছেলের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বছরপূর্তি / রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রসমাবেশ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা

১০

ইরানের কমান্ডার কানি গুপ্তচর কি না, জানাল মোসাদ

১১

যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল ইরানের পরমাণু কর্মসূচি

১২

চাল না কিনলে জাপানে নতুন করে শুল্কের হুমকি যুক্তরাষ্ট্রের

১৩

হলি আর্টিসান হামলার আজ ৯ বছর

১৪

সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফরের ৮৬তম জন্মবার্ষিকী আজ

১৫

কারাগারে যেমন কাটছে মমতাজের

১৬

পাকিস্তানে একযোগে হামলা চালাতে চায় ভারত-ইসরায়েল

১৭

সুনামগঞ্জ-৩ আসনে প্রার্থীর নাম ঘোষণা করল জমিয়ত

১৮

মহররমে বিদআত ও ভ্রান্ত রীতি : যা করণীয়

১৯

যশোর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের পদত্যাগ

২০
X