চলমান সবকিছুর মতো ইতিহাসেরও একটা গতি আছে, রয়েছে বিধি। ইতিহাসের এ গতিবিধি মানুষই নিয়ন্ত্রণ করে, আর এর যে বিবরণ সেও ব্যক্তি মানুষেরই লেখা। বিবরণের লেখক যারা, তারা থাকেন নিজ নিজ স্থানে, কালে ও শ্রেণিতে, সে জন্য যা লিখিত হয় তা একরকমের হয় না, বিবরণকে ভিন্ন ভিন্ন হতেই হয়। ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের কালে ভারতে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছিল, তার লিপিবদ্ধ ইতিহাসেও স্বাভাবিক বিভিন্নতা রয়েছে, ইতিহাস লেখকদের অবস্থানের কারণে। ওই ইতিহাসকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদরা একভাবে দেখেছেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা দেখেছেন সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। সেটাই স্বাভাবিক। ইতিহাসের গতিবিধি দেখার ওই দুই দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য যে থাকবে এটা প্রত্যাশিত, কিন্তু তাদের মধ্যে আবার মিলও রয়েছে। মিলটা এইখানে যে, লীগ, কংগ্রেস উভয় দলের ঐতিহাসিকরাই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকে দেখেছেন নিজেদের উচ্চবর্গের অবস্থান থেকে। ঔপনিবেশিক ইতিহাসবিদরা প্রায় সবাই ব্রিটিশ, তারা মনে করেন যে ব্রিটিশ শাসনের কালে এ উপমহাদেশে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হয়েছে, তার মূল অনুপ্রেরণাটা এসেছে ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকেই। ব্রিটিশের শাসনকালে এখানে যেসব সুযোগ-সুবিধা ও সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার ভাগ পাওয়ার জন্য স্থানীয় উচ্চবর্গের মানুষরা ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে এবং ওই মানুষরাই আবার ভাগবাটোয়ারার প্রশ্নে নিজেদের মধ্যে ভীষণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এ ইতিহাসবিদদের মতে, উপমহাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস মোটামুটি ওই সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতারই ইতিহাস। জাতীয়তাবাদী ভারতবর্ষীয় ইতিহাসবিদরা কিন্তু বলেছেন একেবারেই ভিন্ন কথা। তাদের মতে, আন্দোলন হয়েছে স্বাধীনতার জন্য, সেই আন্দোলনে মানুষ পরিচালিত হয়েছে নিঃস্বার্থ আদর্শবাদিতার অনুপ্রেরণায় এবং আত্মত্যাগ করেছে অকুণ্ঠচিত্তে। এ দুই দৃষ্টিভঙ্গির ভেতর ঐক্য থাকার কথা নয়, ঐক্য প্রতিষ্ঠা ঘটেওনি। কিন্তু দুইয়ের ভেতর ঐক্য যে একেবারেই নেই তাও নয়। আছে এবং সেটা এখানে যে উভয়পক্ষই উচ্চবর্গীয়, এদের হাতে রচিত ইতিহাস বইতে তাই উচ্চবর্গের মানুষদের কথাই থাকে। অথচ দেশে নিম্নবর্গের মানুষ তো ছিল, সংখ্যায় তারাই বেশি, শতকরা পঁচানব্বই ভাগই তারা; স্বাধীনতার জন্য তারাও সংগ্রাম করেছে কিন্তু তাদের কথা উচ্চবর্গীয় কোনো পক্ষই সঠিকভাবে তুলে ধরেনি। ফলে উচ্চবর্গীয় ইতিহাসের নিচে নিম্নবর্গীয় ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে।
নিম্নবর্গের (সাবঅলটার্ন) ইতিহাসবিদরা এ ব্যবস্থাটা মেনে নিতে প্রস্তুত নন। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে নিম্নবর্গের মানুষের যে অংশগ্রহণ তার ইতিহাস উদ্ধারের ব্যাপারে তারা সংকল্পবদ্ধ। তাদের মতে, এ অংশগ্রহণের ঘটনা ও তার তাৎপর্যকে সঠিকভাবে তুলে না ধরলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস তো অসম্পূর্ণ থেকে যাবেই, সে আন্দোলনের চরিত্রকেও সঠিকভাবে অনুধাবন করা সম্ভব হবে না। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নিম্নবর্গের ভূমিকাতে অন্তর্ভুক্ত করার ওই ঐতিহাসিক কাজটিকে গভীর অভিনিবেশ, শ্রম ও দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। অত্যন্ত সংগতভাবেই তারা বিবেচনা করেন যে, ঔপনিবেশিক ইতিহাস মোটেই গণতান্ত্রিক হবে না যদি তাতে নিম্নবর্গের মানুষদের অংশগ্রহণের বহুবিধ ঘটনা জায়গা করে না দেওয়া হয়।
পরাধীনতার কালে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনে নিম্নবর্গের মানুষ অসংখ্য অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। সব নিম্নবর্গের মানুষ একরকমের নয়, তাদের মধ্যে পার্থক্য আছে, বৈচিত্র্য রয়েছে, সব অভ্যুত্থান যে একরকমের ছিল তা নয়, আকারে ও প্রকৃতিতে ভিন্নতা ছিল। কিন্তু আবার মিলও ছিল তাদের মধ্যে। কেননা অভ্যুত্থানগুলোর কোনোটিই অরাজনৈতিক ছিল না, যদিও সেভাবে তাদের চিত্রিত করার চেষ্টা হয়েছে। হ্যাঁ, স্বতঃস্ফূর্ত ছিল অবশ্যই, কিন্তু ভেতরে নির্দিষ্ট চেতনাও ছিল এবং দেশের নানা জায়গায় ঘটা অভ্যুত্থানগুলোর ভেতর ঐক্য ছিল সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার। এ সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতা সফল হয়নি, কিন্তু তাই বলে এতে আপসকামিতা যে দেখা গেছে তাও নয়। উচ্চবর্গের মানুষরা সহজ মীমাংসায় সম্মত হয়, নিম্নবর্গের মানুষরা শেষ দেখে ছাড়তে চায়।
‘নিচ থেকে লেখা ইতিহাস’ বলে ইতিহাস রচনার একটি ধারা আছে। নিম্নবর্গের ইতিহাস লেখকরা এ ধারার অন্তর্গত নন। উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের সম্পর্ক এরা ভিন্নভাবে দেখেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের মতে, উপনিবেশের কালে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের ক্ষেত্রে ওপর এবং নিচ ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র; নিম্নবর্গ উচ্চবর্গের দ্বারা পরিচালিত হয়নি, নিম্নবর্গের মানুষরা নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস তৈরি করে নিয়েছে। ওপর-নিচে সম্পর্ক একটা অবশ্যই থাকে, কিন্তু অভ্যুত্থানকারী নিম্নবর্গ কাজ করে অনেকটা স্বাধীনভাবে, তাদের কাজের এলাকাটা পৃথক, কাজের ধরনও আলাদা। এই ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে উচ্চবর্গ নিম্নবর্গের ওপর কর্তৃত্ব করেছে ঠিকই, কিন্তু আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, উচ্চবর্গের পক্ষে নিম্নবর্গের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করা (হেজিমনি প্রতিষ্ঠা) সম্ভব হয়নি; উচ্চবর্গের কর্তৃত্বটা ছিল নিম্নবর্গের দিক থেকে বশ্যতাহীন (ইংরেজিতে, উইদআউট হেজিমনি)। সংখ্যায় নিম্নবর্গের মানুষ উচ্চবর্গের তুলনায় বহুগুণ বেশি; কিন্তু ক্ষমতা রয়ে গেছে উচ্চবর্গের হাতে, যে জন্য নিম্নবর্গ প্রান্তবর্তী।
নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা নিম্নবর্গকে নিচ থেকে দেখেন না, ওপর থেকে দেখার প্রশ্ন তো ওঠেই না; দেখতে চান ভেতর থেকে। তারা খুঁজতে ও বুঝতে চান নিম্নবর্গের মানুষের চেতনার জগৎটাকে। জিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে নয়, পাঠের মধ্য দিয়ে। ওই চেতনাই হচ্ছে নিয়ামক, তারা মনে করেন। নিম্নবর্গের ওই চৈতন্যকে ইতিহাসের ভেতরে নিয়ে আসা দরকার, নইলে ইতিহাস না হবে পরিপূর্ণ, না গণতান্ত্রিক। নিম্নবর্গের চেতনা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক; সেখানে স্বর বিভিন্ন। সেসব মাত্রা ও স্বরকে খুঁজে পাওয়া কঠিন, তবে তাদের খুঁজে বের করা নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের অঙ্গীকার। তারা চান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উচ্চবর্গীয় ও একপেশে এবং সেই কারণে অনৈতিহাসিক, ইতিহাসবিদ্যাকে স্থানচ্যুত করতে। তা সে ইতিহাসে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের হাতে লেখা হোক, কিংবা ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের হাতে। ভিন্নধারার এ ইতিহাসবিদদের দৃষ্টি কোনো এক জায়গায় আবদ্ধ থাকবে না, এদের ইতিহাস পাঠে রাজনীতি আসবে, থাকবে অর্থনীতি, কিন্তু জোরটা পড়বে গিয়ে সংস্কৃতির ওপর।
নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে একটা রেখাবয়ব আমরা পেতে পারি এদের কাজের শুরুতে প্রকাশিত একটি বক্তব্য থেকে, যেটিকে একটি ঘোষণাপত্রও বলা চলে। ১৯৮১ সালে এদের নিয়মিত-প্রকাশিতব্য রচনাসংকলন সাবঅলটার্ন স্টাডিজের প্রথম খণ্ড প্রকাশের সময়ে এটি লেখা হয়েছিল। লিখেছেন গোষ্ঠীর প্রধান তাত্ত্বিক ও সংগঠক খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। ‘ঔপনিবেশিক ভারতের ইতিহাসবিদ্যার কয়েকটি দিক’ (অন সাম আসপেক্টস অব দ্য হিস্টরিওগ্রাফি অব কলোনিয়াল ইন্ডিয়া) নামের এ প্রবন্ধটিতে যা বলা হয়েছে, দীর্ঘকাল ধরেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস পাঠ উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। এই উচ্চবর্গীয়তা দুই রকমের—একটি ঔপনিবেশিক, অপরটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী। উভয়েরই উদ্ভব ভারতে ব্রিটিশ শাসনের আদর্শিক পরিমণ্ডল থেকে। ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও এই উচ্চবর্গীয়তা বহাল রয়েছে। ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গীয় ইতিহাসবিদরা মূলত ব্রিটিশ; কিন্তু ভারতে এবং অন্যত্র যে তাদের অনুকারীরা নেই তা নয়। অপরদিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদরা প্রায় সবাই ভারতীয়। ইতিহাসের উভয় পাঠই মনে করে যে, ভারতীয় জাতির সৃষ্টি এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশ উচ্চবর্গীয়দের দ্বারাই ঘটেছে।
উচ্চবর্গীয় ইতিহাস পাঠের কোনো উপযোগিতা যে নেই তা নয়। আছে। এই ইতিহাস পাঠ পাঠককে অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে, যার মধ্যে রয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গঠন, বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তার বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম, ওই রাষ্ট্রের সংরক্ষক বিভিন্ন শ্রেণির বিন্যাস, উচ্চবর্গীয়দের যে মতাদর্শ কর্তৃত্ব করেছে তার বিভিন্ন দিক, দেশি ও বিদেশি উচ্চবর্গের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তাদের পারস্পরিক বিরোধ ও সংযোগের জটিলতা, গুরুত্বপূর্ণ ব্রিটিশ ও ভারতীয় ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের ভূমিকা এবং সর্বোপরি উচ্চবর্গের নিজস্ব মতাদর্শ। কিন্তু এই ইতিহাস পাঠ যেখানে ব্যর্থ সেটা হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরিত্রব্যাখ্যা। কেননা ইতিহাসের ওই পাঠ নিম্নবর্গের বিপুলসংখ্যক জনগণের স্বকীয় যে অবদান, যা উচ্চবর্গের অবদান থেকে আলাদা, তার খবর রাখে না। যার খবরই রাখে না তার ব্যাখ্যা সে করবে কী করে?
এই যে ভ্রান্ত ইতিহাস পাঠ, এর মূল কারণ কী? কারণ হলো উচ্চবর্গের নিজস্ব শ্রেণিগত সংকট ও একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি। এ ধরনের ইতিহাস পাঠে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রটিকে মনে করা হয় ভারতশাসনের জন্য ব্রিটিশের খাড়া করা প্রতিষ্ঠান এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত আইন, নীতি, মনোভঙ্গি এবং ওপরকাঠামোর অন্যান্য উপাদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে অনিবার্যভাবেই এ ইতিহাস পাঠে রাজনীতির অর্থ হয়ে দাঁড়ায় ওইসব প্রতিষ্ঠানকে চালু রাখার সঙ্গে যুক্ত ঔপনিবেশিক শাসক ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গোদের অর্থাৎ ভারতবর্ষীয় সমাজের কর্তৃত্বকারী ব্যক্তিদের কার্যকলাপ ও চিন্তাধারার সমষ্টি বৈ অন্যকিছু নয়।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়