কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পে ছোট সুশীলচন্দ্র আর বাপ সুবলচন্দ্রের কথা জানিয়াছি। ছেলের দুষ্টুমিতে বাপ সুবল হইত নাজেহাল। বাপের দৌরাত্ম্যে ছোট সুশীল অতিষ্ঠ হইয়াছিল। ইহার পর সুশীলচন্দ্রের সঙ্গে ইচ্ছাঠাকরুনের দেখা হইল। তখন সে ইচ্ছা করিল বাপের বয়স পাইতে।
ইচ্ছাপূরণ করিয়াছিল ইচ্ছাঠাকুরন। সকাল বেলায় সুশীলচন্দ্র বাপের মতো বড় হইয়া ঘুম থেকে উঠিল। বাপ উঠিল ছেলের মতো ছোট হইয়া। উহাতে তাহারা শান্তি পাইল কি? শান্তি তাহারা পায় নাই। ছেলের দৌরাত্ম্যে সুবল অতিষ্ঠ। বাপের দুষ্টুমিতে সুশীল নাজেহাল। অগত্যা আবারও ইচ্ছাঠাকুরনের কাছে কাঁদিয়া পড়িল সুশীল। ভাগ্যিস সে যাত্রায় বিপদ কাটিয়াছিল। নিজের বয়স ফেরত পাইয়া সুশীল বাঁচিল। তাহার দুষ্টুমিতে সুবলচন্দ্র গলদঘর্ম হইয়া দিন পার করিত।
বহুকাল পর সুশীলচন্দ্র আবারও উদয় হইয়াছিল ইচ্ছাঠাকুরনের সম্মুখে। কী সেই কারণ, তাহা জানিতে উৎসাহ জাগে বৈকি। কবিগুরু স্বর্গনিকেতন গড়িতে ব্যস্ত সময় কাটাইতেছেন বলিয়া নবযুগের গল্পকারকে কলম ভাঙিতে হইবে।
সুশীলচন্দ্র এক্ষণে তরুণ। আগের মতো দুষ্টুমি এই বয়সে বেমানান বিধায় থামিয়াছে, বিষয় তাহা নহে। সুশীলচন্দ্র সামাজিক প্রতিযোগিতায় পড়িয়া দম ফুরাইয়া ফেলাইয়াছে বলা যায়। দিনে দিনে উহার পরীক্ষার ফলাফল সোনালি আভা ধারণ করিলেও প্রাণের উৎসাহ নিভিয়াছে একই গতিতে। বাপ সুবলচন্দ্র বৃদ্ধ বয়সেও দৌরাত্ম্য কম দেখায় না। বিসিএস দিয়া সরকারি চাকুরি পাইতেই হবে সুশীলকে, বাপের এই দাবি মামা বাড়ির আবদার হইয়া আছে আজতক। মামার ভগিনি প্রতিবেশিনীর সাথে পাল্লা দিয়া স্কয়ার ফুটের ঝকঝকে অ্যাপার্টমেন্টে না উঠিয়া মরিবেন না। সুশীল যাহাকে মন দিয়াছিল, সেই সুশীলাও ঠোঁটে পাউট ফুটাইয়া কেবলি লাল গাড়ি চায়।
এই সকল চাওয়া তৎক্ষণাৎ পূরণ করিতে সুশীলচন্দ্র নাচার। আজকাল লেখাপড়ার পাশাপাশি চমৎকার কথা বলিতে পারা, সপ্রতিভ জবাব দিতে পারা, সামাজিক যোগাযোগ বাড়াইতে পারা জরুরি সফট স্কিল সুশীলের নাই। একের পর এক ইন্টার্ভ্যু বোর্ড কর্তৃক অযোগ্য হইয়া সুশীলের দম আরও ফুরাইয়াছে। কেবলি হতাশা। কেবলি দীর্ঘশ্বাস।
উপায় না পাইয়া পপাত ধরনীতল হওয়ার কথা ভাবিয়াছিল সুশীল। সেই সাহস আছে কিনা পরখ করিতে এক সন্ধ্যায় ছাদে উঠিয়াছিল। ইচ্ছাঠাকুরন তখন তাহাকে দেখিয়া চিনিলেন। বেচারার করুণ মুখখানি বড় টানিল। অগত্যা আকাশ হইতে তারা রূপ খসিয়া নামিলেন। সকল বৃত্তান্ত শুনিয়া সুশীলচন্দ্রকে দিলেন এক ছবি। কহিলেন, ইহা ইচ্ছাছবি।
সুশীলচন্দ্র বাগধারা-সমাস-সন্ধি হাতড়াইয়া কূল পাইতেছিল না। ইচ্ছাঠাকুরন বুঝাইয়া দিলেন। যে ছবি দেখিলে ইচ্ছা জাগ্রত হইয়া কার্যে পরিণত হয়, উহাই ইচ্ছাছবি।
কী আছে ছবিতে? সরকারি অফিসের নেমকার্ড গলায় ঝুলাইয়া সুশীলাকে পাশে বসাইয়া হাস্যোজ্জ্বল সুশীলচন্দ্র গাড়ি চালাইতে চালাইতে ঝকঝকে অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ানো বাপ সুবলচন্দ্র ও মামার ভগিনি মাকে টা টা দিতেছে।
ইহার অর্থ স্পষ্ট। সুশীলচন্দ্র নিজেই গাড়ি চালাইবে! ভয় জন্মাইল বুকের ভেতর। ড্রাইভিং পরীক্ষার লিখিত অংশ পার হইলেও স্টিয়ারিং লইয়া ডান-বাম ঠিকঠাক রাখিতে হইবে ভাবিয়া গলদঘর্ম সুশীল লাইসেন্স মেলাইতে পারে নাই। ঘুষ দিয়া একখানা জোগাড় করিলেও উহার জোরে নিজের গাড়ি নিজে চালানোর সাহস করা যায় না। অগত্যা গাড়ির সাথে একখানা চালক পাইবার ইচ্ছা করিতেই দেখে ইচ্ছাঠাকরুন উধাও।
যখনি মনে পড়িত সুশীলচন্দ্র ছবিখানা বাহির করিয়া দেখিত। ছবির ঝকঝকে সুশীলচন্দ্রকে দেখিতে ভালো লাগিত। টানটান গ্রীবা, উলম্ব পৃষ্ঠ, দ্বিধাহীন দৃষ্টি, ভুবনভোলানো বাঁকা হাসির টান সুশীল মরমে মরমে অনুভব করিতে লাগিল। এই রকম হইতে সে কি পারে না?
আজকাল সুশীলচন্দ্র নিজের ভেতরে ছবির সুশীলচন্দ্রকে নিয়া ঘোরে। আয়নার সামনে দাঁড়াইয়া রপ্ত করে ছবির সুশীলচন্দ্রকে। নিজের দৃষ্টিতে নিজেই দৃষ্টি ফেলিয়া প্রতিনিয়ত নিজেকে জানায়, পারিবে। নিশ্চয়ই পারিবে। আয়নার সুশীলের সাথে কথোপকথন চালাইতে চালাইতে সমাজের অন্য ব্যক্তির সাথে কথোপকথনের জড়তা কমিল। কিছুকাল পর টের পাইল, ভয় কমিয়াছে। কিছুকাল পর ইন্টারভ্যু বোর্ড জয় করিল ভয়হীন সুশীলচন্দ্র।
এই জয়ের কৃতিত্ব বাপ সুবলচন্দ্রসহ অনেকেই উহাদের অবদান বলিয়া প্রচার করিতে ব্যস্ত হইল। নড়িতে অনিচ্ছুক কাহাকেও অন্যে ঠেলিয়া নড়াইতে পারে কি? সুশীলচন্দ্র ভালো করিয়াই জানে, যাহা করিবার তাহা নিজেকেই করিতে হয়। ইচ্ছাঠাকুরনের দেওয়া ইচ্ছাছবি উহাকে এই শিক্ষাই দিয়াছে।