শিশু-কিশোর থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ সব বয়সেই এ রোগের প্রকোপ দেখা যেতে পারে। বিশেষ করে শীতের কুয়াশাঘেরা ভোরে কারোর যদি সাইনোসাইটিসের কারণে তীব্র মাথাব্যথা, বন্ধ নাক এবং মৃদু শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঘুম ভেঙে যায় সেটি অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।
সাইনোসাইটিস কী ও কেন হয়
আমাদের মাথার খুলির হাড়ের ভেতর কপাল, অক্ষিকোটরের চারপাশে, গালের হাড়ের ভেতরে এবং নাকের পেছনে চারপাশে পরস্পর সংযুক্ত যে ফাঁপা বায়ুভর্তি গর্তগুলো রয়েছে এগুলোকে বলা হয় সাইনাস। এই গর্তের ভেতরের দিকে আবরণী ঝিল্লিতে কোনো কারণে প্রদাহ বা ঘা হলে অথবা কোনো ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে ইনফেকশন হলে তাকে বলা হয় ‘সাইনোসাইটিস’।
সাইনাস বা আমাদের মুখমণ্ডলের ফাঁপা বায়ুভর্তি এ অংশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আমাদের শ্বাসনালির আর্দ্রতা ধরে রাখা এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র ধূলিকণা, অ্যালার্জেন ও বায়ুবাহিত জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষায় সাহায্য করা। এ ছাড়া ফাঁপা অংশের কারণেই আমরা আমাদের মাথার খুলির ভেতর প্রায় দেড় কেজি ওজনের মস্তিষ্ক সহকারে চলাফেরা করতে বেগ পেতে হয় না।
কারণ কপালের হাড়ের ভেতর (ফ্রন্টাল সাইনাস), চোখের নিচের অংশে (ম্যাক্সিলারি সাইনাস), করোটির ভেতরে (স্ফেনয়ডাল ও এথময়েডাল সাইনাস) এ সাইনাসগুলো হাড়ের ওজন সমন্বয় সাধন করে, অর্থাৎ মাথার ওজন হালকা রাখে। গলার স্বরের কম্পন, শব্দ তৈরি ও অনুরণনেও সাইনাসের ভূমিকা রয়েছে।
কেন হয়
সাধারণত নাক, কান, গলা, শ্বাসনালি এবং দাঁতের কোনো অসুখ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোনো অস্বাভাবিকতা যাদের থাকে তাদের ক্ষেত্রে সাইনোসাইটিসের প্রকোপ বেশি দেখা যায়। নাকের বাঁকা হাড়, পলিপ, দাঁত ও মাড়ির দীর্ঘমেয়াদি রোগ, প্রকৃতিসৃষ্ট ধুলাবালি, গাড়ি বা কলকারখানার ধোঁয়া, ধূমপান এসব কিছুই সাইনোসাইটিস রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
এ ছাড়া হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট, ঘন ঘন সর্দি-কাশি, টনসিলাইটিস, ঠান্ডাজনিত বা অ্যালার্জিজনিত রাইনাইটিস এসবই সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ফাঙ্গাসের সংক্রমণে এমনকি অ্যালার্জিজনিত কারণেও সাইনাসে ইনফেকশন হয়ে থাকে।
লক্ষণ ও উপসর্গ
প্রাথমিকভাবে তীব্র মাথাব্যথাসহ চোখের পেছনের অংশে ব্যথা, কপাল ভারী হয়ে ব্যথাসহ নাক বন্ধ থাকা বা ঘন সর্দি, পাশাপাশি জ্বর এগুলোই অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগের লক্ষণ। সাইনোসাইটিসজনিত মাথাব্যথা সাধারণত দিনের শুরুতে কম থাকে এবং ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, মাথা নিচু করে রাখলে তা আরও বৃদ্ধি পায়।
পাশাপাশি অবসাদগ্রস্ততা, অরুচি, নাক বন্ধ থাকা, নাক দিয়ে পাকা হলুদ সর্দি ঝরা, কফসহ কাশি, চোখ চুলকানো, চোখ দিয়ে পানি পড়া, নাকের গন্ধের অনুভূতি লোপ পেতে পারে। গলার প্রদাহ, শ্বাস-প্রশ্বাসে দুর্গন্ধ হতে পারে। হাঁপানি রোগীদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের সমস্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। খাবারের স্বাদ-গন্ধ লোপ পেতে পারে। পাশাপাশি জ্বরও থাকতে পারে।
রোগ নির্ণয়
নাকের এক্সরে করলে সাইনাসের কোনো ইনফেকশন থাকলে সেটি ঘোলাটে দেখায়, পাশাপাশি নাকের হাড় বাঁকা বোঝা যায়।
অ্যালার্জির পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা যায়। বুকের এক্সরে সব ধরনের রোগীদের জন্য বাধ্যতামূলক। প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা, এ ছাড়া বয়স ৪০ পার হলে রক্তের সুগার এবং ইসিজি করা হয়।
একজন চিকিৎসক সাধারণত এ পরীক্ষাগুলো করে বুঝতে পারেন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফাঙ্গাসজনিত কারণে নাকি অন্য কোনো অ্যালার্জিজনিত কারণে সাইনোরাইনাইটিস হয়েছে। তিন মাসের অধিক সময় ধরে সংক্রমণ (সাধারণত ব্যাকটেরিয়াজনিত) থাকলে তাকে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি সাইনোসাইটিস বলা হয়।
প্রতিকার
সাইনাসজনিত সমস্যায় রোগীদের মেডিসিন, নাক-কান, গলা এবং বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞদের চিকিৎসা দেন। সাইনাসের দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ বা ইনফেকশনের জন্য প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করতে হবে।
ইনফেকশনের পরিমাণ বেশি হলে এবং ওষুধে না সারলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় এন্ডোসকপি সার্জারির মাধ্যমে সাইনাসের পুঁজ, ময়লা বের করা হয় যাকে অ্যান্ট্রাল ওয়াশ বলা হয়। এখানে প্রচলিত ভুল ধারণার বিপরীতে উল্লেখ্য, একবার সাইনাস পরিষ্কার করলেই বারবার পরিষ্কার করতে হয় না।
প্রতিরোধ
বারবার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে হলে ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং জীবনযাত্রার ধরনে কিছুটা পরিবর্তন এ যন্ত্রণাদায়ক রোগ প্রতিরোধে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
→ ঠান্ডা পানীয় ও খাবার পরিহার করতে হবে সামগ্রিকভাবে।
→ ধুলাবালি এড়াতে রাস্তাঘাট ও কর্মক্ষেত্রে সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
→ যাদের সাইনোসাইটিসের সমস্যা রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে বাড়িতে লোমশ পশু বা পাখি পালন করা যাবে না কারণ পশুর লোমের কারণে মানবদেহে অ্যালার্জেন প্রবেশ করে অ্যালার্জিক সাইনোরাইনাইটিস করতে পারে। একই কারণে কার্পেট বা লোমশ পোশাক এড়িয়ে চলতে হবে।
→ ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে।
→ দাঁতের ক্ষয় এবং অন্যান্য পচনশীল পদার্থ থেকে দাঁতের সংক্রমণ প্রতিরোধে যত্নশীল হতে হবে নিজেকেই।
→ নিয়মিত নিয়মমাফিক হাঁটা বা হালকা ব্যায়ামের অভ্যাস করতে হবে।
→ সর্বোপরি রোগ প্রতিরোধে সহায়ক এমন খাদ্যাভ্যাস তৈরি করতে হবে।
যে কোনো স্বাস্থ্য সমস্যায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই সর্বোত্তম সিদ্ধান্ত। আর যেসব অসুখে বারবার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে সেসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সচেতনতাই পারে তা প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে। শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে মানসিক ভারসাম্য ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে বিধায় সুস্বাস্থ্যের অনুভূতি এক কথায় অতুলনীয়।
দেহ ও মনের অসুস্থতা আমাদের মনোযোগ ও কর্মযজ্ঞে সরাসরি বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। তাই সুস্থ থাকার উদ্দেশ্যে জীবনযাত্রায় ও খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন-পরিশোধন করা গেলে তার প্রভাব সামগ্রিকভাবে আমাদের জীবনধারণকে আরও সহজ এবং সুস্থ করে তুলতে সহায়ক হবে।