দেশে প্রতি পাঁচজনে একজন উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। একসময় শুধু বয়স্ক ব্যক্তিরা আক্রান্ত হতেন। এখন শিশু-কিশোররাও ভুগছে। অকালে উচ্চ রক্তচাপের একমাত্র কারণ তরুণ প্রজন্মের অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন। যেহেতু এ রোগের তেমন কোনো উপসর্গ নেই, আর অল্প বয়সে কেউ নিয়মিত রক্তচাপ মাপেও না, তাই এটি হয়ে যায় নীরব ঘাতক। এ বছর তাই দিবসটির প্রতিপাদ্য—‘নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন, দীর্ঘদিন বাঁচুন।’
উচ্চ রক্তচাপ কী
উচ্চ রক্তচাপকে ডাক্তারি ভাষায় হাইপারটেনশন বলে। দেহের স্বাভাবিক রক্তচাপ সিস্টোলিক ১২০ এবং ডায়াস্টোলিক ৮০। ব্যক্তির রক্তচাপ যখন নিয়মিত এর তুলনায় বেশি (সিস্টোলিক ১৪০, ডায়াস্টোলিক ৯০) থাকে, তখন তাকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন বলে। অতিলবণযুক্ত ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, ওজন বৃদ্ধি ও কায়িক শ্রমের অভাব, মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা ইত্যাদি কারণে অল্পবয়সীদের উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বেড়ে যায়।
আবার বিভিন্ন ধরনের রোগের কারণেও রক্তচাপ বাড়তে পারে। কম বয়সে হঠাৎ বাড়তি রক্তচাপ পাওয়া গেলে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। যেমন জন্মগতভাবে শরীরের প্রধান রক্তনালিতে সংকোচন বা কোনো সমস্যা যেমন কোয়ারকটেশন অব অ্যাওর্টা, তাকায়াসু আর্টারাইটিস ইত্যাদি আছে কি না তা পরীক্ষা করতে হবে। বংশগত কিডনি রোগ, কিডনির প্রদাহ, ত্রুটিপূর্ণ কিডনি, কিডনির রক্তনালির সমস্যা (রেনাল আর্টারি স্টেনোসিস) বা কিডনির টিউমার হলেও রক্তচাপ যে কোনো বয়সে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে পারে।
আবার হরমোনজনিত সমস্যা (যেমন থাইরয়েড, অ্যাড্রিনাল বা পিটুইটারি গ্রন্থির সমস্যা), মস্তিষ্কের টিউমার বা জন্মগত ত্রুটি, লুপাস, রক্তনালির প্রদাহ (ভাসকুলাইটিস), দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন করলে রক্তচাপ বেশি থাকতে পারে। ছোটদের ক্ষেত্রে কিডনির প্রদাহ উচ্চ রক্তচাপের প্রধান কারণ। শিশুদের লালচে প্রস্রাব, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া, শরীরে পানি আসাও এর লক্ষণ। আবার থাইরয়েডের সমস্যা কিশোরী, তরুণীদেরও দেখা যায়। হঠাৎ মুটিয়ে যাওয়া, মাসিকে সমস্যা, গর্ভপাত ইত্যাদি হলে থাইরয়েডের সমস্যার সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপের সম্পর্ক আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখা দরকার।
লক্ষণ
উচ্চ রক্তচাপের সাধারণত কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। অনেকেই আছেন, যারা জানেন না যে তারা উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব।
ঝুঁকি
দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ও চিকিৎসাবিহীন উচ্চ রক্তচাপের কারণে স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশি দুর্বল হয়ে যায়। এতে হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এতে মস্তিষ্কে রক্তের চাপ বেড়ে স্ট্রোকও হতে পারে। কিডনির কার্যক্ষমতার পাশাপাশি রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্বও আনতে পারে উচ্চ রক্তচাপ।
করণীয়
* উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি সুপরিকল্পিত খাদ্যতালিকা অনুসরণ করা জরুরি।
* ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
* লবণ ও চিনিজাতীয় খাবার কমাতে হবে।
* তেল ও চর্বিজাতীয় খাবার কম খেতে হবে।
* প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটতে হবে।
* পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিতে হবে।
* মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তামুক্ত থাকতে হবে।
* ধূমপান-মদ্যপান বাদ দিতে হবে।
* শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, যোগাসন অথবা মেডিটেশনও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অনেক সময় কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
* নিয়মিত রক্তচাপ পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।
লেখক: ডা. নাজমুন নাহার মিলি
মেডিসিন, কার্ডিওলজি এবং ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ